ত্রিমুখী লড়াইয়ে দু’জনেরই পরিচয় বহিরাগত। ঘরের ছেলে বলতে একজনই। তবে পুরশুড়ার মানুষের কাছে সকলেই স্বাগত। তা না হলে গরমে কাঠফাটা রোদে প্রচারের সময় প্রার্থীদের স্বস্তি দিতে গাছের তলায় শতরঞ্জি এবং চেয়ারের ব্যবস্থা থেকে মাটির কলসি, বালতিতে পানীয় জল এবং বাতাসার ব্যবস্থা কেন। শুধু তাই নয়, প্রার্থী এলাকায় এলে শাঁখ বাজানো, ফুল ছোড়া, প্রার্থীর কপালে চন্দনের টিকা দেওয়ার ছবিও চোখে পড়ছে।
ভোটলক্ষ্মীর এমন আবাহনে আপ্লুত শাসক থেকে বিরোধী সব দলের প্রার্থীই। নিজের নিজের মতো যে যার প্রচারের বিষয় ঠিক করে নিলেও ভোটারদের এমন আচরণে শাসক-বিরোধী সকলেই বলছেন, ‘মানুষ আমাদের সঙ্গেই আছেন’।
আগের বিধানসভায় দেগঙ্গায় দলের প্রার্থী ছিলেন। সেখান থেকে তুলে এ বার তাঁকে পুরশুড়ায় প্রার্থী করেছেন তৃণমূল নেত্রী। তাঁর উপর নেত্রীর অগাধ ভরসার কথা বললেও এই কেন্দ্রে তাঁর বিরুদ্ধে ‘বহিরাগত’ তকমা যে বিরোধীদের অন্যতম অস্ত্র তা ভালই জানেন এম নুরুজ্জামান। তবে সে সব গায়ে না মেখে ‘উন্নয়নের নিরিখে এবং উন্নয়নের ধারা বজায় রাখতে ভোট দিন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাত শক্ত করুন’—এই স্লোগান নিয়েই দোরে দোরে হত্যে দিচ্ছেন। তাঁর কথায়, ‘‘প্রচার সভাগুলোতে মানুষকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি অতীতে সিপিএমের সন্ত্রাসের কালো দিনগুলোর কথা। ২০০৯ সালে লোকসভা নির্বাচনের পর ১২ জন খুন হয়েছিলেন এই কেন্দ্রে। সেই পরিস্থিতি যাতে আর না ফিরে আসে সেই আবেদন রাখছি। জিতব বলেই আশা করছি।’’
প্রতিপক্ষ বাম-কংগ্রেস জোটের কংগ্রেস প্রার্থী প্রতীম সিংহ রায় বলছেন ‘তৃণমূলের জমানায় লুণ্ঠিত গণতন্ত্র’ পুনরুদ্ধারের কথা। প্রার্থীর দাবি, ‘‘তৃণমূলের অপশাসন, মহিলাদের নিরাপত্তার অভাব, নারদ স্টিং অপারেশন-সহ অন্যান্য দুর্নীতি— প্রচারে সবই মানুষকে জানাচ্ছি। তাঁরা যে ভাবে সাড়া দিচ্ছেন তাতে জেতার আশা দেখছি।” এক সময় এখানকার বৈকুণ্ঠপুরে আদি বাস ছিল। তবে গত চার দশক ধরে হরিপালের বাসিন্দা। তাই ‘বহিরাগত’ তকমা সেঁটেছে তাঁর গায়েও। আদি বাসের সূত্রে প্রতীমবাবু তা অস্বীকার করলেও তা কতটা এড়াতে পারবেন বলা শক্ত।
সেদিক থেকে স্থানীয় পরিচিতিতে এই দু’জনকে পিছনে ফেলেছেন বিজেপি প্রার্থী। স্থানীয় শ্যামপুরের বাসিন্দা শুভেন্দু মুখোপাধ্যায়কে প্রার্থী করে প্রথম রাউন্ডেই কয়েক কদম এগিয়ে গিয়েছে বিজেপি। কোনও বহিরাগত নয়, কোনও ‘অতিথি’ নয়। জিতলে আপদে বিপদে তাঁকেই যে পুরশুড়ার মানুষ কাছে পাবেন প্রচারে তা বলতে ভুলছেন না শুভেন্দুবাবু। সারদা, নারদ, উড়ালপুল থেকে নানা দুর্নীতি নিয়ে তৃণমূলকে আক্রমণের পাশাপাশি ‘ফের সন্ত্রাস ফেরার’ আশঙ্কা মনে করিয়ে বিঁধছেন সিপিএম তথা বাম-কংগ্রেস জোটকেও। বিজেপি প্রার্থীর কথায়, ‘‘মানুষকে বোঝাচ্ছি তৃণমূল এবং জোট প্রার্থী দুজনেই বহিরাগত। পুরশুড়ায় কেউ থাকবেন না। পুরশুড়ার কথা কেউ ভাববেন না। তাই ঘরের ছেলেকে চিনতে যেন তাঁরা ভুল না করেন।”
প্রার্থীদের নানা দাবি সত্ত্বেও কী বলছে পুরশুড়ার ইতিহাস?
১৯৬৭ থেকে ১৯৭২, কংগ্রেসের দখলে ছিল এই কেন্দ্র। ১৯৭৭ সালে জয়ী হয় সিপিএম। ১৯৮২তে ফের গড় দখল করলেও ’৮৭ সাল থেকে টানা ২০০৬ পর্যন্ত সিপিএমের একচ্ছত্র আধিপত্য দেখেছেন এখানকার মানুষ। ২০১১য় সেই আধিপত্যে থাবা বসায় তৃণমূল-কংগ্রেস জোট। জোট প্রার্থী পারভেজ পান ১,০৭,৭৯৪টি ভোট। সিপিএমের সৌমেন্দ্রনাথ বেরা পান ৭৬,১০৪টি ভোট। বিজেপির ভোট ছিল ৭,৭১৮টি। পুড়শুড়ার কংগ্রেস নেতা শম্ভুনাথ মালিকের দাবি, পারভেজের প্রাপ্ত ভোটের ১৮ শতাংশ ছিল কংগ্রেসের। এ বার সেই হার আরও বাড়বে।
তবে ভোটাররা যে ভাবে সব দলের প্রার্থীদেরই বাতাসা-জল খাওয়াচ্ছেন তাতে কার ভোট কোথায় পড়বে তা নিয়ে স্থানীয় রাজনৈতিক মহলে কাটাছেঁড়া চলছে বিস্তর। পাশাপাশি ভোট-সন্ত্রাসও যে ভোটারদের ভাবাচ্ছে তার প্রমাণ মিলেছে। যেমন চিলাডাঙির প্রৌঢ় শঙ্কর সরকার। আগের বাম আমল এবং বর্তমানের শাসক দলের ভোট দেখেছেন। বললেন, ‘‘আমরা সাধারণ মানুষ শান্তি চাই। কারা প্রকৃতপক্ষে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে পারে, দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গড়তে পারে তা নিয়ে ভাবার সময় হয়েছে।”
বালিপুর অঞ্চলের গৃহবধূ সবিতা মণ্ডলের কথায়, ‘‘সব দলের ছেলেরাই ঘরে এসে ঝান্ডা এবং প্রতীক দেখিয়ে বলছে ‘বৌদি মনে আছে তো’? সবাইকেই বলছি ‘মনে থাকবে না আবার’। কারও মুখে গণতন্ত্র, কারও মুখে উন্নয়নের ফিরিস্তি। আসলে সবই তো মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ।”
যদিও এর মধ্যেই অনেকের গলায় উঠে এসেছে আশঙ্কার প্রশ্ন, ‘ভোটটা দিতে পারব তো’?