আইন অনুযায়ী তিন মাসে যা পাওয়ার কথা তা পেতে কেটে গেল তেরো বছর।
২০০৫ সালে রিষড়ার এক জুটমিলের শ্রমিক বছর পঁয়তাল্লিশের দিলীপ কাহার কর্মরত অবস্থায় মারা যান। স্বামীর মৃত্যুর পর মিলের বকেয়া আর পেনশনের টাকা তুলতে গিয়ে ধাক্কা খেয়েছিলেন পঁচিশ বছরের গীতাদেবী। দিলীপবাবু আদৌ তাঁর স্বামী কি না প্রশ্ন তুলেছিলেন মিল কর্তৃপক্ষ। এক বছরের সন্তানকে কার্যত পথে বসা গীতাদেবী বাধ্য হয়েছিলেন আইনি চিঠি নিয়ে পিএফ কমিশনারের দরজায় কড়া নাড়তে। তেরো বছরের লড়াই শেষে অবশেষে কাটল বকেয়া নিয়ে সেই জট।
কর্মরত শ্রমিকের মৃত্যু বা কোনও শ্রমিকের অবসরের পর তাঁদের পরিবারকে দ্রুত বকেয়া মেটানোর জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের শ্রম দফতর বহুবার সতর্ক করেছে রাজ্যের মিল কর্তৃপক্ষকে। তিন মাসের সময়ও বেঁধে দেওয়া হয়েছে। প্রভিডেন্ট ফান্ড দফতরও একই নির্দেশ জারি করেছে। কিন্তু গীতাদেবীর ঘটনা ফের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল নির্দেশ আর বাস্তবায়নের মধ্যে ফারাকটা কত বেশি।
গীতাদেবী জানান, ২০০৫ সালে কর্মরত অবস্থায় মারা গিয়েছিলেন দিলীপবাবু। বকেয়া আর পেনশনের টাকা তুলতে নির্বাচন কমিশনের ভোটার কার্ড, আধার, পুরপ্রধানের চিঠি- সব কিছু তথ্য-প্রমাণ নিয়ে তিনি দ্বারস্থ হয়েছিলেন মিল কর্তাদের। গীতাদেবীর কথায়, ‘‘আমার কাছে তো সব প্রমাণই ছিল। অথচ ওঁরা কিছুই দেখলেন না। শুধু তাই নয়, আমি আদৌ মৃতের স্ত্রী কিনা, সেই প্রশ্নও তুললেন।’’ বকেয়া মিলবে না নিশ্চিত জেনেই আয়ার কাজ করে সংসার চালিয়েছেন গীতাদেবী।
২০১৫ সাল নাগাদ দিলীপবাবুর সহকর্মীদের মারফত চন্দননগর আইনি সহায়তা কেন্দ্রের দ্বারস্থ হন গীতাদেবী। প্রথমে ওই আইনি সহায়তা কেন্দ্রের তরফে মিল কর্তৃপক্ষকে নোটিস দেওয়া হয়। কিন্তু তাতেও কর্ণপাত করেননি মিল কর্তৃপক্ষ। এরপর শ্রম দফতরে আবেদন জানানো হয়। সেখানেও বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ। চন্দননগর আইনি সহায়তা কেন্দ্রের কর্ণধার বিশ্বজিৎ মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘ইতিমধ্যে হাইকোর্টে আমরা আবেদন জানাই। জানানো হয় দিল্লির পিএফ কমিশনারকেও। দুই পক্ষের কড়া নির্দেশের পরই গীতাদেবী তাঁর প্রাপ্য আড়াই লক্ষ টাকা পান।’’
জেলার প্রবীণ বাম শ্রমিক নেতা তথা প্রাক্তন সাংসদ শান্তশ্রী চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘কাজ করেও এই রাজ্যের শ্রমিকদের বকেয়া পেতে বিস্তর কাঠ-খড় পোড়াতে হয় গীতাদেবীর ঘটনাই তার প্রমাণ।’’ বিশ্বজিৎবাবুর কথায়, ‘‘শ’য়ে শ’য়ে শ্রমিক এভাবেই প্রতিদিন প্রতারিত হচ্ছেন। গীতাদেবীর ঘটনা নারী নির্যাতনের সামিল। তাঁকে স্ত্রী বলেই অস্বীকার করা হয়েছিল। শ্রমিক সমস্যার সুরাহায় রাজ্যের শ্রম দফতরের ভূমিকাও ঠিক নয়।’’ এই বিষয়ে শ্রম দফতর বা মিল কর্তৃপক্ষ অবশ্য মুখ খুলতে চাননি।