সাদামাঠা ভাবে তৈরি হচ্ছে মণ্ডপ। শনিবার। — সুব্রত জানা
লক্ষ্মী প্রতিমা আনতে ট্রাক নিয়ে নদিয়ার কৃষ্ণনগরে যাচ্ছিলেন ক্লাবের সদস্যরা। কিছুটা যেতেই বদলে গেল ট্রাকের রুট। ছুটল মর্গের দিকে। কিছুক্ষণ পরে পাড়ার লোকজন দেখলেন, প্রতিমা নয়, ট্রাকে এল এক যুবকের নিথর দেহ। এই চিত্র দশমীর দিন বিকেলে দেখা গিয়েছিল বাগনানের জোকা গ্রামে।
লক্ষ্মী পুজোর তোড়জোড় শুরু হওয়ার আগেই বেজে গেল বিদায়ের ঘণ্টা। শনিবার দুপুরে এই গ্রামে গিয়ে দেখা গেল অর্ধসমাপ্ত মণ্ডপে বসে রয়েছেন ক্লাবের সদস্যরা। মণ্ডপের কাঠামোতেই ফ্লেক্স লাগানো আছে। তাতে লেখা, ‘পথ দুর্ঘটনায় আমাদের পাড়ার যুবক অতনু মাইতির মৃত্যুর ঘটনায় আমরা শোকস্তব্ধ।’
হাওড়া জেলায় বেশ জাঁকজমক ভাবে লক্ষ্মীপুজো হয় জয়পুরের খালনা গ্রামে। সেই মানচিত্রে খালনার পরে গত কয়েক বছর ধরেই জায়গা করে নিয়েছে জোকা। দামোদরের তীরে অবস্থিত এই গ্রাম মূলত চাষের উপরেই নির্ভরশীল। কিন্তু কয়েক বছর আগে পর পর বন্যা ও খরায় চাষের বেশ ক্ষতি হয়। তখন থেকেই লক্ষ্মীর আরাধনায় মনোনিবেশ করেন গ্রামবাসীরা। পাঁচ বছরের মধ্যে তা পাল্লা দিতে থাকে খালনার সঙ্গে। অন্তত ১৫টি সর্বজনীন লক্ষ্মীপুজো হয়। যাদের বাজেট গড়ে ১ লক্ষ থেকে ৪ লক্ষ টাকা পর্যন্ত। পুজোর সময়ে আলোয় ভেসে যায় গোটা গ্রাম। বাজতে থাকে বক্স। মণ্ডপে থিমের ছড়াছড়ি দেখা যায়।
কিন্তু এ বার জোকা গ্রামে ঢুকে দেখা গেল, গোটা এলাকা যেন ঝিমিয়ে রয়েছে। বক্স বা মাইকের শব্দ নেই বললেই চলে। রঙিন আলো নয়। রাস্তার ধারে লাগানো হয়েছে সাদা টিউবলাইট। প্রায় তিন লক্ষ টাকা বাজেটের পুজো করে ইন্টারন্যাশনাল ক্লাব। এ দিন সকাল পর্যন্ত তাদেরও মণ্ডপও অর্ধসমাপ্ত। আলোকসজ্জা, মাইক বাদ দেওয়া হয়েছে। বিশিষ্ট ব্যক্তিদের দিয়ে পুজোর উদ্বোধন করা হয় অন্যবার। এ বার তা হচ্ছে না। তবে প্রতিমা আনা হয়েছে। ক্লাবের সদস্যরা জানালেন, প্রতিমার বরাত দেওয়া হয়ে গিয়েছিল। তাই তা বসাতে হয়েছে। না হলে পুজোটাই এ বছর করতেন না তাঁরা। ভাইভাই সঙ্ঘের পুজোর এ বারের বাজেট ছিল প্রায় ২ লক্ষ টাকা। কিন্তু তা কমিয়ে নামানো হয়েছে মাত্র ৭০ হাজারে। সব রকমের আড়ম্বর বন্ধ। অন্য দিকে প্রায় ৩ লক্ষ টাকা বাজেটের পুজো করছে শীতলামাতা সঙ্ঘ। তাদের মণ্ডপ অবশ্য ভালই হয়েছে। ডাইনোসরের মূর্তির আদলে তৈরি হয়েছে মণ্ডপ। তবে ক্লাব কর্তারা জানালেন, বাদ দেওয়া হয়েছে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। একই রকম ছবি দেখা গেল, বেশিরভাগ ক্লাবে।
কিন্তু কেন?
জোকার বাসিন্দারা জানালেন, মাত্র ছ’মাসে পথ দুর্ঘটনায় এই গ্রামেরই অন্তত ১২ জন যুবকের মৃত্যু হয়েছে। তাতে শেষ সংযোজন হলেন বছর ২২-এর অতনু। নবমীর রাতে প্রতিমা দেখতে বেরিয়েছিলেন তিনি। পরের দিন ভোরে হেঁটে বাড়ি ফেরার পথে খাদিনান গ্রামের কাছে একটি গাড়ির ধাক্কায় তাঁর মৃত্যু হয়। ক্লাব সৃষ্টির সদস্য অনুপম ধাড়া বললেন, ‘‘অতনু শুধু পাড়ার ছেলে নয়। তাঁর বাবা আমাদের ক্লাবের সদস্যও। তাই এ বার পুজো বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।’’ অন্য ক্লাব কর্তারাও জানালেন, একের পর এক দুর্ঘটনা গ্রামের ঘুম কেড়ে নিয়েছে। তাই আড়ম্বর বাদ দেওয়াই নয়, বেশিরভাগ পুজো কমিটি তাদের বাজেট কাটছাঁট করেছে।
একই পথে হাঁটছে ছোটরাও। সব মিলিয়ে বিষাদে কাটাছে জোকা গ্রাম।