আতঙ্ক নিয়েই মৃত্যু দিল্লির নিষিদ্ধ পল্লি থেকে উদ্ধার বাসন্তীর ছাত্রীর

হাসপাতালে আনার সময়ে এক নাগাড়ে মেয়েটি বলছিল, “আমাকে ছুঁয়ো না। আমার সঙ্গে অমন করছ কেন?” হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পরেও কাউকে কাছে ঘেঁষতে দেয়নি। শেষ পর্যন্ত মৃত্যু এসে নিয়ে গেল তাকে। দক্ষিণ ২৪ পরগনার বাসন্তীর সোনাখালির মেয়েটির শেষ আশ্রয় ছিল হুগলির একটি হাসপাতাল। বাড়ির লোকেরা জানান, আর পাঁচটা মেয়ের মতোই বেড়ে উঠছিল ওই কিশোরী। বাসন্তীর রামচন্দ্রখালি উচ্চ বিদ্যালয়ে ক্লাস নাইনে পড়ছিল।

Advertisement

প্রকাশ পাল

শ্রীরামপুর শেষ আপডেট: ১৩ মার্চ ২০১৫ ০১:৩৮
Share:

হাসপাতালে আনার সময়ে এক নাগাড়ে মেয়েটি বলছিল, “আমাকে ছুঁয়ো না। আমার সঙ্গে অমন করছ কেন?” হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পরেও কাউকে কাছে ঘেঁষতে দেয়নি।

Advertisement

শেষ পর্যন্ত মৃত্যু এসে নিয়ে গেল তাকে। দক্ষিণ ২৪ পরগনার বাসন্তীর সোনাখালির মেয়েটির শেষ আশ্রয় ছিল হুগলির একটি হাসপাতাল। বাড়ির লোকেরা জানান, আর পাঁচটা মেয়ের মতোই বেড়ে উঠছিল ওই কিশোরী। বাসন্তীর রামচন্দ্রখালি উচ্চ বিদ্যালয়ে ক্লাস নাইনে পড়ছিল। গত বছরের ২৬ এপ্রিল স্কুলে যাওয়ার পথে সে পাচার হয়ে যায় দিল্লির গাজিয়াবাদের নিষিদ্ধপল্লিতে। সেখানে অমানবিক অত্যাচার চলে। বহু চেষ্টায় উদ্ধার হওয়ার পর যখন সে ফিরে আসে, তখন প্রবল জন্ডিসে আক্রান্ত সে। সেই সঙ্গে যৌন অত্যাচারেরও আতঙ্ক ও আঘাতও তাকে বিপর্যস্ত করে রেখেছিল।

মেয়েটির পরিবার এবং পরিচিতদের বক্তব্য, মেয়েটি নিখোঁজ হওয়ার পরে পুলিশ কেবল অভিযোগ নিয়েই দায় সারে। মূলত স্কুলের প্রধান শিক্ষক আজিজুল ইসলাম এবং ইতিহাসের শিক্ষক জাফর ইকবালের চেষ্টায় দিল্লির একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার মাধ্যমে সে বাড়ি ফেরে। তার পরে অবশ্য প্রশাসনের উদ্যোগে অল্প কিছুদিন একটি হোমে রাখা হয় তাঁকে। তখন থেকেই শরীরে নানা জটিল রোগ দেখা দেয়। কিন্তু দিন আনি দিন খাই সংসারে সে ভাবে চিকিৎসা পায়নি মেয়েটা।

Advertisement

সম্প্রতি খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে দেয় ওই কিশোরী। শারীরিক কষ্টের সঙ্গে যোগ হয়েছিল তার মানসিক বিপন্নতা। বারবার আর্তি জানাতে থাকে, কেউ যেন তাঁকে না ছোঁয়। শিক্ষক জাফর ইকবাল যোগাযোগ করে মেয়েটিকে গত ১ ফেব্রুয়ারি শ্রীরামপুরের শ্রমজীবী হাসপাতালে নিয়ে আসেন। চিকিৎসক এবং চিকিৎসাকর্মীদের অভিজ্ঞতা বলছে, প্রথম দিকে কাউকেই কাছে ঘেঁষতে দিচ্ছিল না সে। জোর করেই ঘুমের ওষুধ দিতে হয়েছিল। বেশ কয়েক বোতল রক্তও দিতে হয়। রাইলস টিউব দিয়ে খাওয়ানো হয়। রক্তে বিলিরুবিনের মাত্রা অনেকটাই বেড়ে গিয়েছিল, প্রভাব পড়েছিল মস্তিষ্কে। সেই সঙ্গে যৌনাঙ্গে আঘাত ছিল। কিন্তু চিকিৎসক-নার্সদের মনে ছাপ ফেলে গিয়েছে মেয়েটির মানসিক বিপন্নতা। সব সময়ে মনে হত, কোনও ভয়ে কুঁকড়ে যাচ্ছিল ওই কিশোরী। বোঝা যায়, যৌনপল্লীর আতঙ্ক সে কাটিয়ে উঠতে পারেনি। দরিদ্র পরিবারের কিশোরীর খরচ হাসপাতালই চাঁদা তুলে জোগাড় করেছিল। শেষ রক্ষা হল না।

বেলুড় শ্রমজীবী স্বাস্থ্য প্রকল্প মিশনের সম্পাদক অনিল সাহা-সহ বেশ কয়েকজন চিকিৎসক মেয়েটির চিকিৎসা করেছেন। অনিলবাবু বলেন, “মেয়েটি জন্ডিসে কাহিল ছিল। তার উপরে মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত ছিল। কোনও অবাঞ্ছিত পুরনো ঘটনা মনে পড়ার ফলে এমনটা হয়ে থাকতে পারে।” মনোবিদ মোহিত রণদীপও মনে করেন, “যে শারীরিক অত্যাচার ওর উপরে হয়েছিল, তাতেই মানসিক বিপর্যয়ের শিকার হয়ে পড়ে মেয়েটা। এই সমস্ত ক্ষেত্রে পুরনো ঘটনা ফ্ল্যাশব্যাকের মতো ফিরে আসতে থাকে মনে। চূড়ান্ত নিরাপত্তাহীনতা ঘিরে ধরে। কাউকে দেখলেই নির্যাতিতা মনে করতে থাকে, তার ক্ষতি করার চেষ্টা করছে।”

শ্রীরামপুর কলেজের সমাজ দর্শনের শিক্ষক প্রভাকর ভট্টাচার্য বলেন, “এই সমস্ত ক্ষেত্রে পুলিশের ভূমিকা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। দোষীদের ধরে শাস্তিবিধান করতে হবে তাদের। তা না হলে বার বার অপরাধ করেও পার পেয়ে বিকৃত মানসিকতার লোকজনের অপরাধপ্রবণতা বেড়েই যাবে। তার শিকার হবে অসহায় মেয়েরা।”

ইকবাল বলেন, “ফিরে এসে ও জানিয়েছিল কী অত্যাচারটাই না ওর উপর হয়েছিল। কিন্তু পুলিশ কিচ্ছু করেনি। রক্ষকের কী এই ভূমিকাই হওয়া উচিত?” তাঁর কথায়, “মেয়েটাকে দেখলেই বোঝা যাচ্ছিল, একটা ভয় ওকে কুরে কুরে খাচ্ছে।” মেয়েটির বাবাও বলেন, “পুলিশ কাউকে ধরেনি।” মেয়েটি বাড়ি ফেরার পরে পুলিশের কাছে লিখিত ভাবে জানিয়েছিল, তাকে পাচার করা হয়েছিল। জড়িতদের নামধামও জানিয়েছিল। কিন্তু কেউ ধরা পড়েনি। পুলিশ অবশ্য নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগ মানেনি।

বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সদস্যরা জানাচ্ছেন, কখনও কাজের টোপ দিয়ে, কখনও বিয়ের টোপ দিয়ে মেয়েদের পাচার করার অনেক চক্র রয়েছে। এ রাজ্যের নানা জায়গা থেকে প্রচুর মেয়ে দিল্লিতে পাচার হয়। পুলিশ কখনও তাদের ফেরাতে উদ্যোগী হয়, কখনও দেখছি-দেখব করে কর্তব্য সারে। কখনও কোনও কিশোরাীর খোঁজ মিললেও ফিরিয়ে আনা যায় না। অল্প বয়সে কারও বিয়ে হয়ে যায়। কেউ মারাত্মক শারীরিক অসুস্থতায় ভুগতে থাকে। কখনও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের হাত ধরে বাড়িতে ফিরতে পারলেও স্বাভাবিক জীবনে ফেরা সহজ হয় না। এইচআইভি বা হেপাটাইটিস বি-এর মতো রোগের জীবাণু বাসা বাধে শরীরে। মানসিক যন্ত্রণা থেকেও মুক্তি মেলে না।

ইকবাল বলেন, “ও খুব প্রিয় ছাত্রী ছিল আমাদের। ওর মৃত্যুটা যেন সবাইকে শেখাতে পারে, অসহায় মেয়েদের পরিণতি। এমন ঘটনা কী ভাবে আটকানো যায়, সবার তা দেখা উচিৎ।” হোগল নদীর তীরে তার বাড়ি ছেড়ে, হুগলির একটি হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছিল মেয়েটা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন