ক্রীড়াজেলা কি নামেই, প্রশ্ন চন্দননগরে

১৯১১ সালে আইএফএ শিল্ড জয়ী মোহনবাগানকে প্রদর্শনী ম্যাচে হারিয়ে দিয়েছিল এ শহরের ছেলেরা। ওই বছরেই। এ শহরেরই কবাডি খেলোয়াড় ভোলানাথ গুঁই অর্জুন পুরস্কার পেয়েছিলেন ১৯৭৩-এ।

Advertisement

গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায় ও প্রকাশ পাল

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৮ জুলাই ২০১৪ ০১:০২
Share:

শতাব্দীপ্রাচীন চন্দননগর স্পোর্টিং ক্লাব।

১৯১১ সালে আইএফএ শিল্ড জয়ী মোহনবাগানকে প্রদর্শনী ম্যাচে হারিয়ে দিয়েছিল এ শহরের ছেলেরা। ওই বছরেই।

Advertisement

এ শহরেরই কবাডি খেলোয়াড় ভোলানাথ গুঁই অর্জুন পুরস্কার পেয়েছিলেন ১৯৭৩-এ।

বদ্রু বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে চুনী গোস্বামী কলকাতা মাঠের বহু নামী ফুটবলার এক সময়ে খেলে গিয়েছেন এ শহরের মাঠে।

Advertisement

চন্দননগর বললেই লোকের চোখে ভাসে স্ট্র্যান্ড, জগদ্ধাত্রী পুজো, ফরাসি ঐতিহ্য আর বাহারি আলো। কিন্তু ক্রীড়াক্ষেত্রেও এ শহরের সমান ঐতিহ্য রয়েছে। ফুটবল, ক্রিকেট, ভলিবল, কবাডি, ব্যাডমিন্টন, হকি, অ্যাথলেটিক্স, পর্বতারোহণ নানা খেলার নানা আয়োজন বহু দিন ধরেই ছড়িয়ে রয়েছে এ শহরের বুকে। কিন্তু হাল আমলে শহরে ফুটবল-সহ বিভিন্ন খেলার মান কমছে বলে আক্ষেপ রয়েছে চন্দননগরের বহু ক্রীড়াপ্রেমীর। এ জন্য ক্রিকেটের রমরমাকে দুষছেন অনেকে। তাঁদের প্রশ্ন, ক্রীড়াজেলা হয়ে লাভ কি হল?

চন্দননগর স্পোর্টস অ্যাসোসিয়েশন ফুটবল, ক্রিকেট-সহ ছ’টি খেলার নিয়ন্ত্রক সংস্থা। সংস্থার ফুটবল সম্পাদক শুভদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় স্বীকার করছেন, নানা কারণে গত কয়েক বছরে বহু মানুষই মাঠ-বিমুখ হয়ে পড়েন। একই সঙ্গে তাঁর দাবি, “গত তিন বছরে আমরা মানুষকে মাঠমুখী করার চেষ্টা করেছি। বিভিন্ন খেলায় এ শহরের ছেলেদের বেশি করে সুযোগ দেওয়ার চেষ্টা চলছে। মহিলা ক্রিকেট দলও তৈরি হয়েছে।”

এ শহরের খেলাধুলোর অতীত নিয়ে কথা বলতে গিয়ে এখনও গর্বে ফুলে ওঠেন প্রবীণ ক্রীড়াপ্রেমীরা। বলে যান একের পর এক গল্প। সেটা ১৯৪৯ সাল। জওহরলাল নেহরু দেশের প্রধানমন্ত্রী। তখনও ফরাসি শাসনাধীন চন্দননগরের ভবিষ্যৎ নিয়ে গোল-টেবিল বৈঠক হচ্ছে দিল্লিতে। চন্দননগরের তৎকালীন গভর্নর মঁসিয়ে বাঁজা ঠিক কী শর্তে চন্দননগরের হস্তান্তর প্রক্রিয়ায় রাজি হবেন, হিসেব হচ্ছে তারই। বৈঠকের সিদ্ধান্ত মতো তৈরি হল ঝা কমিশন। সেই কমিশনের সুপারিশ ছিল চন্দননগরকে দেশের প্রথম ‘ক্রীড়া জেলা’ (স্পোর্টস ডিস্ট্রিক্ট) হিসেবে ঘোষণা করতে হবে। শহর জুড়ে নানা ক্রীড়ার যে আয়োজন, তা যাতে আরও ভাল ভাবে বিকশিত হয়, সে কথা ভেবে কমিশনের সুপারিশ মান্যতা পেল।

১৮৮০ সাল নাগাদ শহরের কুঠির মাঠে প্রথম ফুটবল খেলা শুরু হয় মূলত ফরাসি নৌ-সেনাপতি রেনে লেফ্রেসারের উদ্যোগে। ১৮৮৮-তে তৈরি হল চন্দননগর স্পোর্টিং ক্লাব। ১৯১১ সালে তারা ট্রেডস কাপ চ্যাম্পিয়ন হয়। ফুটবলে এক সময় কলকাতা ময়দান কাঁপিয়েছিলেন এ শহরের ছেলে সতীশচন্দ্র পলসাই। প্রথম জীবনে এখানকার ক্লাবে খেলে গিয়েছেন চুনী গোস্বামী, তাঁর দাদা মানিক গোস্বামী, সমরেশ (পিন্টু) চৌধুরীরা। ফুটবল এবং হকি দুই খেলাই দাপিয়ে খেলেছেন শম্ভুজা মুখোপাধ্যায়। কৃষ্ণগোপাল চৌধুরী কলকাতার তিন বড় ক্লাবেই সসম্মানে খেলেছেন সেই সত্তরের দশক থেকে। স্বপন পলসাই, বিজয় দিকপতিও নাম করেছিলেন ফুটবলে। প্রবাদপ্রতিম ফুটবলার সামাদও চন্দননগরের মাঠে খেলেছেন। ১৯৫৬ সালে মেলবোর্ন অলিম্পিকে যাওয়ার আগে ভারতীয় ফুটবল দল কুঠির মাঠে খেলে গিয়েছিল বদ্রু বন্দ্যোপাধ্যায়ের অধিনায়কত্বে। কিন্তু গত কয়েক বছরে কলকাতার মাঠে চন্দননগরের ফুটবলার কোথায়?

পুরনো স্মৃতি এখনও উজ্জ্বল সমরেশের। বললেন, “সেটা ষাটের দশক। আমার ফুটবলার-জীবনের উত্থানই চন্দননগর থেকে। তখন চন্দননগর বয়েজ ক্লাব এবং সিসি ক্লাব প্রবল প্রতিন্দ্বন্দ্বী ছিল। আমি ছিলাম বয়েজ ক্লাবে। সেই সময় মাঠে প্রবল উন্মাদনা ছিল। মাঠ ভর্তি লোক থাকত।”

স্মৃতির ফ্রেমে। চন্দননগরের প্রথম মহিলা ক্রিকেট দল।

কবাডিতেও বহু উজ্জ্বল নক্ষত্রের জন্মদাতা এই শহর। বান্ধব সম্মিলনী, হাটখোলা, তরুণ সঙ্ঘ,শক্তি সঙ্ঘ, কাবারিপাড়া, যুব সঙ্ঘ কবাডিতে নাম করেছিল। কবাডি খেলেই ভোলানাথ গুঁই অর্জুন পুরস্কার পেয়েছেন। এখানে ক্লে কোর্টে টেনিস হয় চন্দননগর স্পোর্টিং, সিসি ক্লাব, চন্দননগর বয়েজ স্পোর্টিং ক্লাবে। ভলিবলে সিসি ক্লাবের দিলীপ মণ্ডল ১৯৫৫ সালে টোকিওতে অনুষ্ঠিত এশিয়ান ভলিবল চ্যাম্পিয়নশিপে খেলেছিলেন। বইয়ের পাতায় গোন্দলপাড়া এলাকার রাধানাথ বেড়েল নামে এক পালোয়ানের নাম মেলে, যিনি ফোর্ট উইলিয়ামে গিয়ে সেখানকার এক সাহেব পালোয়ানকে হারিয়ে ছিলেন। অতীতের এমন বহু উজ্জ্বল উদাহরণ আরও রয়েছে।

তবে, সব খেলাকে কয়েক কদম পিছনে ফেলে দিয়েছে ক্রিকেট। এখন ভোরে বা বিকেলে শহরের বিভিন্ন ক্লাবে ক্রিকেট কিট নিয়ে ভিড় জমায় কচিকাঁচারা। চন্দননগর বয়েজ স্পোর্টিং, জুপিটার স্পোর্টিং, ফ্রেন্ডস ক্লাব, ওরিয়েন্টাল স্পোর্টিংয়ের মতো ক্লাব স্থানীয় ক্রিকেটে যথেষ্ট জনপ্রিয়। এখানকার সতীন্দ্র নন্দী রেলের হয়ে রঞ্জি খেলেছেন। ত্রিপুরার হয়ে খেলেছেন সত্রাজিৎ লাহিড়ি। বর্তমানে বাংলার উদীয়মান ক্রিকেটার অনুষ্টুপ মজুমদারও এই শহরেরই ছেলে। অনুষ্টুপ ভারতীয় ‘বি’ দলেও জায়গা করে নিয়েছেন।

তা সত্ত্বেও সার্বিক ভাবে শহরের খেলাধুলোর মান কমছে বলেই অভিমত বহু ক্রীড়াপ্রেমীর। এ জন্য পরিকাঠামোর অভাবকেও দুষছেন কেউ কেউ। স্থানীয় ফুটবল লিগে দলের সংখ্যা কমেছে গত কয়েক বছরে। হকি লিগের সেই সুনাম আর নেই। আশি ছুঁইছুঁই প্রাক্তন আম্পায়ার অসীমকুমার চট্টোপাধ্যায় বলেন, “সবাইকে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হতেই হবে। তাই মাঠ খা খা করে। দেখে খারাপ লাগে।” আর এক প্রবীণের কথায়, “ক্রিকেট ছাড়া আর যেন কোনও খেলা নেই। ছেলেদের সঙ্গে বাবা-মায়েরাও এখন ক্রিটে মাঠে ভিড়করছেন। অন্য খেলা হবে কী করে?”

পুরসভার দাবি, খেলাধুলোর উন্নয়নে তারা সচেষ্ট। এ জন্য শহরে ইন্ডোর স্টেডিয়াম তৈরি হচ্ছে।

ছবি: তাপস ঘোষ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন