কুশীলবদের সমন্বয় চক্র, নাট্যচর্চার সুদিন ফেরাতে উদ্যোগী অধ্যাপক

সত্তরের দশকের গোড়ায় আরামবাগে একে একে তৈরি হয়েছিল গোটা ১৫ নাটকের দল। তিরিশ বছর পেরিয়ে বেশির ভাগই উঠে গিয়েছে। টিম টিম করে দু’একটি টিকে থাকলেও দীর্ঘ দিনই তাদের কোনও নাটক নেই।

Advertisement

পীযূষ নন্দী

আরামবাগ শেষ আপডেট: ০২ জুলাই ২০১৪ ০১:৪২
Share:

ফাল্গুনী গুপ্ত। নাট্যচর্চায় মগ্ন। ছবি: মোহন দাস।

সত্তরের দশকের গোড়ায় আরামবাগে একে একে তৈরি হয়েছিল গোটা ১৫ নাটকের দল। তিরিশ বছর পেরিয়ে বেশির ভাগই উঠে গিয়েছে। টিম টিম করে দু’একটি টিকে থাকলেও দীর্ঘ দিনই তাদের কোনও নাটক নেই। সেই সব ভেঙে যাওয়া নাটকের দলগুলির কুশীলবদের নিয়ে একটি সমন্বয় চক্র গড়ে আরামবাগের নাট্যচর্চাকে উজ্জীবিত করতে উদ্যোগী হয়েছেন চাঁপাডাঙা কলেজের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ফাল্গুনী গুপ্ত মজুমদার।

Advertisement

২০১২ সালের গোড়ায় ফাল্গুনীবাবুরই সতীর্থ চিকিৎসক তথা নাট্যপ্রেমী প্রয়াত শিবনাথ বসু এই কাজের সূচনা করেছিলেন। বন্ধুর সেই অসম্পূর্ণ কাজ সম্পূর্ণ করতে উদ্যোগী হয়েছেন ফাল্গুনীবাবু। তিনি জানান, সমন্বয় চক্রের মূল উদ্দেশ্য হল নাটকের নিয়মিত দর্শক তৈরি করা। তিনি বলেন, বর্তমানে আরামবাগে নাট্যচর্চা নেই বললেই চলে। ব্যক্তিকেন্দ্রিক হয়ে যাওয়ায় দলগুলি টিকে থাকছে না। সেই সঙ্কট থেকে বেরোতেই ছন্নছাড়া হয়ে পড়া দলগুলির সদস্যদের নিয়ে সমন্বয় চক্র তৈরি করা হয়েছে। নাট্য আন্দোলনকে উজ্জীবিত করতে আগে যে চেষ্টা হয়নি তা নয়, তবে সেটা বিশেষ একটা দলের উদ্যোগ, সম্মিলিত নয়।

২০০৮ সালের অগাস্ট মাসে গণনাট্য সঙ্ঘের আরামবাগের অয়ন শাখা বছরভর নাটক নামে একটি কর্মসূচি নিয়েছিল। কিন্তু মাস দুই যেতে না যেতেই দর্শকের অভাবে উৎসাহ হারিয়ে ফেলেন ওই দলের ৩০ জন সদস্য। অতীতেও এরকম একক ভাবে চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু পরিণতি হয়েছে একই।

Advertisement

১৯৭২ সালে আরামবাগের প্রথম নাটকের দল “নটনাট্যম” গড়ে তুলেছিলেন আরামবাগ নেতাজি মহাবিদ্যালয়ের দর্শনের অধ্যাপক প্রয়াত শীতাংশু দত্ত। পরের বছর ১৯৭৩ সালের জানুয়ারিতে আরামবাগ উৎসবে সাত দিন ধরে অভিনয় হয়েছিল মনোজ মিত্রের লেখা নানা নাটক। দর্শকের কোনও ঘাটতি ছিল না। তারপর আশির দশক অবধি রমরমিয়ে চলেছে সেই নাটক চর্চা। তারই ফলশ্রুতিতে সব্যসাচী গুপ্ত মজুমদারের শতাব্দীর কৃষ্টি বা অশোক সোমের ‘চিত্র চরিত্র’, শ্যামল চট্টোপাধ্যায়ের ‘ব্লকপাড়া যুবগোষ্ঠী’ গড়ে ওঠে। পরে ১৯৮২ সালে নাট্য আন্দোলনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নেয় বুবু (প্রবীর) বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাট্যদল ‘নরক গুলজার’। টানা তিন বছর সফলভাবে রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় নাটক মঞ্চস্থ করে অনেক পুরস্কারও পায় দলটি। এর সঙ্গে সঙ্গে ‘সুচেতনা’, ‘রামমোহন নাট্যশালা’, এবং ‘মুখোশ’ নামের চারটি গোষ্ঠীও নাটক চর্চার ধারা বজায় রাখে। তখনই তৈরি হয় হীরক মুখোপাধ্যায়ের ‘প্রবাহ’, শ্যামল চট্টোপাধ্যায়ের ‘জাগরণ’।

ওই নাটকের দলগুলির সদস্যদের বক্তব্য, “আমরা সবাই চেষ্টা করেছিলাম নাটকে মানুষের কথা বলতে। কিন্তু একটা সময়ের পরে আর দর্শক হল না। কীসের অভাবে নাটকের দলগুলি টিকছে না, তা আমাদের কাছে এখনও স্পষ্ট না।”

অনেক নাট্যকর্মীর মতে, নাটকের বক্তব্য ও বিষয় ভাবনায় দৈন্য থাকায় দর্শক আর তা নিচ্ছে না। আবার অনেকের মতে, এখনকার প্রজন্মের যারা নাটক করতে আসছে, তারা সহজে নাম করার জন্য গিমিক দেওয়া শুরু করেছে। তাতে নাটক তার সারবত্তা হারাচ্ছে।

এখনও বিভিন্ন দলের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলছেন আরামবাগের বিশিষ্ট নাট্যকর্মী সঞ্জীব চক্রবর্তী। তাঁর মতে, “নাটকটাকে কাজ হিসাবে নিতে পারিনি আমরা। নিছক অবসর কাটানোর উপায় হিসেবে দেখেছি। দীর্ঘস্থায়ী কোনও ভাবনাচিন্তাও ছিল না। আর সেই জন্যেই হয়তো দলগুলো টেকেনি। না হলে কোনও বাধাই নাটকের প্রতিবন্ধক হতে পারে না।”

তবে এলাকার নাট্যকর্মীদের একাংশের দাবি, আর্থিক দুরাবস্থা ও নাটকের উপস্থাপনার জন্য প্রশাসনিক অসহযোগিতাও নাট্য চর্চার বড় অন্তরায়। তাঁরা জানান, আরামবাগে অনেক প্রেক্ষাগৃহ তৈরি হলেও নাটকের জন্য বিশেষ সুযোগ সুবিধার ব্যবস্থা নেই। হল ভাড়া বাবদ আড়াই থেকে তিন হাজার টাকা দাবি করে দলগুলি। কিন্তু অত টাকা দেওয়ার সামর্থ্য নাটকের দলগুলির নেই। তারা বড়জোড় ৮০০ থেকে ১০০০ টাকা অবধি দিতে পারে। স্বাভাবিকভাবেই নাট্য আন্দোলন থমকে যায়। সেক্ষেত্রে প্রশাসনের কাছ থেকে বিশেষ সুবিধা পেলে হয়তো নাট্যচর্চা কিছুটা হলেও বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন