সাজা ঘোষণার পরে রাকেশ মিশ্র (পিছনে)। —নিজস্ব চিত্র।
বিনা দোষে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের পড়ুয়া এক যুবককে চলন্ত ট্রেন থেকে ঠেলে ফেলে দিয়েছিলেন আরপিএফের সাব ইনস্পেক্টর। তাতে মৃত্যু হয় হুগলির মগরার বাঘাটির ওই যুবকের। সতেরো বছর আগের সেই ঘটনায় অনিচ্ছাকৃত খুনের দায়ে বুধবার রাকেশ মিশ্র নামে ওই আরপিএফ অফিসারকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের সাজা দিল চুঁচুড়া আদালত।
পুলিশ সূত্রে জানা যায়, নিহত নরোত্তম দত্ত কলকাতার সিটি কর্মাশিয়াল কলেজে এক বছরের ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং কোর্স পড়ছিলেন। ঘটনার দিন, অর্থাৎ ১৯৯৮ সালের ৯ জুলাই ছিল তার শেষ ক্লাস। সন্ধ্যার পর কলেজ থেকে বেরিয়ে বাড়ি ফেরার জন্য হাওড়া স্টেশন থেকে ১০টা ১০ মিনিটের শেষ হাওড়া-বর্ধমান মেন লাইনের ট্রেন ধরেন তিনি। তেষ্টা পাওয়ায় ব্যান্ডেলে ট্রেন থেকে নেমে কলে জল খেতে যান। ইতিমধ্যেই ট্রেন ছেড়ে দেওয়ায় তিনি দৌড়ে একটি কামরায় ওঠেন। সেটি ছিল মহিলা কামরা। সেখানে আরপিএফের কয়েক জন কর্মী উঠেছিলেন। মহিলা কামরা হওয়ায় ব্যান্ডেলের পরের স্টেশন আদিসপ্তগ্রামে নামতে গেলে ওই আরপিএফ কর্মীরা তাঁকে বাধা দেন।
রাত সাড়ে ১১টা নাগাদ ট্রেন পৌছয় তাঁর গন্তব্য মগরা স্টেশনে। কিন্তু সেখানেও আরপিএফের কর্মীরা তাঁকে নামতে দেননি। শেষ ট্রেন হওয়ায় নরোত্তম জোর করেই নামার চেষ্টা করেন। প্ল্যাটফর্মে দাঁড়ানো লোকজন ওই ঘটনা দেখতে পান। তবে তার মধ্যেই ট্রেন ছেড়ে দেয়। মগরা স্টেশন ছেড়ে ট্রেন কিছুটা এগোতেই রাকেশ মিশ্র ওই যুবককে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে ট্রেন থেকে ফেলে দেন। গুরুতর জখম অবস্থায় তিনি রেল লাইনের পাশে একটি খাটালের ধারে ছিটকে পড়েন। মাথা, বুক, পায়ে গভীর আঘাত লাগে। গোঙানি শুনে খাটালের লোকজন তাঁকে উদ্ধার করেন। তাঁরাই মগরা স্টেশনে খবর দেন। রেলের লোকজন এবং অন্য যাত্রীরা ছুটে আসেন। তাঁকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় চুঁচুড়া ইমামবাড়া হাসপাতালে। অবস্থার অবণতি কলকাতার একটি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।
তিন দিন পরে নরোত্তমের বাড়ির লোক এবং ট্রেনের সহযাত্রীরা ব্যান্ডেল জিআরপি থানায় রাকেশ মিশ্রের নামে খুনের চেষ্টার অভিযোগ দায়ের করেন। এ দিকে, কলকাতার হাসপাতালে কিছুটা ভাল হবার পর নরোত্তমকে চুঁচুড়ার একটি নাসিংহোমে নিয়ে আসা হয়। ওই বছরেরই ২১ অগস্ট ওই নার্সিংহোমেই নরোত্তমের মৃত্যু হয়। পুলিশ রাকেশকে গ্রেফতার করে। পরে সুপ্রিম কোর্ট থেকে তিনি জামিনে ছাড়া পান। বর্তমানে তিনি হাওড়া স্টেশনে আরপিএফের ইনস্পেক্টর পদে কর্মরত ছিলেন।
মামলার সরকারি আইনজীবি নারায়ণ ভদ্র জানান, নিহত যুবকের সহযাত্রী, তাঁর বাড়ির লোক মিলিয়ে মোট ২৮ জনের সাক্ষ্য নেওয়া হয়। দীর্ঘ শুনানির পরে মঙ্গলবার রাকেশকে দোষী সাব্ব্যস্ত করেন চুঁচুড়া আদালতের অতিরিক্ত দায়রা বিচারক (ফার্স্ট কোর্ট) অরূপকুমার বসু। ওই দিনই রাকেশকে হেফাজতে নিয়ে নেয় আদালত। এ দিন ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩০৪ ধারায় ওই আরপিএফ অফিসারকে যাব্বজীবন সশ্রম কারাদণ্ডের সাজা শোনান বিচারক। পাশাপাশি ১০ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও ১ বছর সশ্রম কারাদণ্ডেরও নির্দেশ দেন তিনি।
বাবা নির্মল দত্ত এবং মা মঞ্জুদেবীর একমাত্র সন্তান ছিলেন নরোত্তম। চলতি মাসের ১২ তারিখে নির্মলবাবু মারা যান। মঞ্জুদেবী বলেন, “বিনা দোষে আমার জোয়ান ছেলেটাকে ট্রেন থেকে ফেলে দেওয়া হয়েছিল। আদালতের রায়ে আমার প্রাণ জুড়িয়েছে। তবে, স্বামী ছেলের খুনির সাজা দেখে যেতে পারলেন না, এটাই আক্ষেপ।”