শ্যামপুরের মরশাল জুনিয়র হাইস্কুল।
শিক্ষকের অভাবে হাওড়া জেলার নিউ সেট আপ আপার প্রাইমারি স্কুল ও জুনিয়র হাইস্কুলগুলির হাল শোচনীয়। জেলায় এই ধরনের স্কুল রয়েছে ১৫০টি। প্রতিটি স্কুলে গড়ে ৬ জন করে স্থায়ী পদের শিক্ষক থাকার কথা। বলাবাহুল্য কোনও স্কুলেই তা নেই। কোথাও একজন, কোথাও দু’জন শিক্ষক রয়েছেন। গুটিকয় স্কুলে ৩-৪ জন করে শিক্ষক রয়েছেন।
২০১৪ সাল থেকে বলবৎ হয়েছে শিক্ষার অধিকার আইন। যার মূল কথা কোনও ছেলেমেয়েকেই শিক্ষার আওতার বাইরে রাখা যাবে না। আইন যাতে পুরোপুরি বলবৎ করা যায় সে জন্য ২০১০ সাল থেকেই সরকার এ ব্যাপারে প্রস্তুতি শুরু করে। তারই অঙ্গ হিসাবে জেলায় জেলায় নিউ সেট আপ আপার প্রাইমারি স্কুল এবং জুনিয়র হাইস্কুল চালু করা হয়। এইসব স্কুল গড়ার ক্ষেত্রে নিয়ম হল, গ্রামে ২ কিলোমিটারের মধ্যে যদি হাইস্কুল না থাকে তা হলে সেখানে এই স্কুল করা যায়। শহরের ক্ষেত্রে এই ধরনের স্কুল খোলার নিয়ম ১ কিলোমটারের মধ্যে সীমাবদ্ধ। অর্থাৎ এক কিলোমিটারের মধ্যে কোনও হাইস্কুল না থাকলে এই স্কুল খোলা চলবে।
পঞ্চম থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত এখানে পঠনপাঠনের ব্যবস্থা রয়েছে। মূলত স্কুলছুটদের জন্যই স্কুলগুলি গড়া হয়। এর জন্য গ্রামবাসীদের জমির ব্যবস্থা করতে হয়। স্কুলবাড়ি তৈরি এবং শিক্ষক নিয়োগ করার কথা সরকারের। এইসব স্কুলে মিড ডে মিল এবং ছাত্র-ছাত্রীদের পোশাক দেওয়ার নিয়মও আছে। নিজেদের ছেলেমেয়েদের শিক্ষার কথা ভেবে স্কুল খোলার জন্য গ্রামবাসীরা জমি দিতে এগিয়ে আসায় গত চার বছরে হাওড়া জেলায় নিউ সেট আপ আপার প্রাইমারি এবং জুনিয়র হাইস্কুল খোলার হিড়িক পড়ে যায়। ইতিমধ্যেই দেড়শো স্কুল গড়ে উঠেছে। স্কুলগুলি চালানোর জন্য প্রথম দিকে অস্থায়ীভাবে অতিথি শিক্ষক নিয়োগ করা হয়েছিল। তাঁদের জানানো হয়েছিল স্কুল সার্ভিস কমিশন থেকে স্থায়ী শিক্ষক এলে তাঁদের চলে যেতে হবে। কিন্তু একদিকে যেমন পর্যাপ্ত শিক্ষক পাঠাতে পারেনি স্কুল সার্ভিস কমিশন, তেমনই অতিথি শিক্ষকদের নিয়েও তৈরি হয়েছে সমস্যা। অতিথি শিক্ষকদের সাহায্যে স্কুলগুলি প্রথম দিকে ভাল চললেও বছর দুই হল বেতন নিয়ে অতিথি শিক্ষকদের সঙ্গে স্কুল শিক্ষা দফতরের বিবাদে নতুন করে অতিথি শিক্ষক নিয়োগ বন্ধ হয়ে গিয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী যে সব অতিথি শিক্ষকের এখনও চাকরি রয়েছে, তাঁদেরও চুক্তি আর নবীকরণ না করানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে স্কুল শিক্ষা দফতর। এর ফলে স্কুলগুলিতে শিক্ষকের অভাব চরম আকার নিয়েছে।
এই ধরনেরই একটি স্কুল আমতার ঘোষপুর আপার প্রাইমারি স্কুল। ২০১১ সালে তৈরি এই স্কুলে এ পর্যন্ত মাত্র এক জন শিক্ষিকাকে পাঠিয়েছে স্কুল সার্ভিস কমিশন। স্কুলে অতিথি শিক্ষক দু’জন। তাঁদের চুক্তি আর নবীকরণ করা হবে না বলে জানিয়ে দেওয়ার পর তাঁরাও স্কুলে অনিয়মিত হয়ে পড়েছেন। স্কুল সার্ভিস কমিশন যাঁকে পাঠিয়েছে তিনি আবার প্রধান শিক্ষিকাও। ফলে জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ সব দায়িত্বই তাঁকে সামলাতে হচ্ছে। স্কুলের ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ১৫৩ জন। সংখ্যালঘু এবং তফসিলি সম্প্রদায়ের পড়ুয়াই বেশি।
একমাত্র শিক্ষক অসুস্থ থাকায় স্কুল বন্ধের নোটিস।
স্কুল পরিচালন সমিতির সভাপতি অমল চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘দিনের পর দিন জেলা স্কুল পরিদর্শকের কাছে শিক্ষকের জন্য দরবার করেছি। কিন্তু আজও শিক্ষক পাইনি। এই অবস্থায় স্কুল চলবে কী করে বুঝতে পারছি না।’’ একই ছবি শ্যামপুরের মরশাল জুনিয়র হাইস্কুলে। ২০১০ সালে তৈরি এই স্কুলের পঠন-পাঠন চালু হয়েছিল তিনজন অতিথি শিক্ষককে নিয়ে। ২০১৩ সালে একজন স্থায়ী শিক্ষক কাজে যোগ দেন। কিন্তু চুক্তি শেষ হওয়ায় তিন জন অতিথি শিক্ষক বিদায় নিয়েছেন। নতুন কোনও অতিথি শিক্ষক নিয়োগ হয়নি। ফলে একজন শিক্ষকই কোনওমতে পরিস্থিতি সামলাচ্ছেন। এক সময়ে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ছিল ৯৮ জন। শিক্ষক না থাকায় তা কমতে কমতে ২৬ জনে ঠেকেছে। ঝাঁ চকচকে স্কুলবাড়ি। দেওয়া হয় মিড ডে মিল। হয় না শুধু পড়াশোনাই। গত ১৮ জুলাই স্কুলে গিয়ে দেখা গেল ঝাঁপ বন্ধ। বাইরে দেওয়ালে বিজ্ঞপ্তি সাঁটানো, ‘শিক্ষক অসুস্থ থাকার জন্য স্কুল ১৮ জুলাই থেকে ২২ জুলাই পর্যন্ত বন্ধ থাকবে’। স্কুল পরিচালন কমিটির সদস্য অরূপ মাজি বললেন, ‘‘বলুন তো, এ ভাবে পড়াশোনা হয়! স্কুলটা মনে হয় উঠেই যাবে।’’
জেলা স্কুল পরিদর্শক দফতর সূত্রের খবর, গোটা হাওড়াতেই এমন ছবি। রাজ্য স্কুল শিক্ষা দফতরের এক পদস্থ আধিকারিক জানান, শিক্ষক চেয়ে তাঁরা স্কুল সার্ভিস কমিশনে নিয়মিত দরবার করলেও প্রয়োজনীয় শিক্ষক মেলে না। তাঁর বক্তব্য, চাহিদা যতই থাক, তা পূরণ করতে গেলে অর্থ দফতরের অনুমোদন প্রয়োজন। যতজন শিক্ষক দরকার ততগুলি পদের জন্য কখনই অনুমোদন দেয় না অর্থ দফতর। সে জন্যই বছরের পর বছর শূন্য পদগুলি ফাঁকাই থেকে গিয়েছে।
অনেক ক্ষেত্রে এমন ছবিও দেখা গিয়েছে, পাশাপাশি দু’টি নিউ সেট আপ আপার প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষক নিয়োগের মধ্যে সামঞ্জস্য নেই। কোনও স্কুলে হয়তো রয়েছেন মাত্র এক জন শিক্ষক। অথচ তার পাশের স্কুলেই রয়েছেন ৩ জন শিক্ষক। যেখানে ৩ জন শিক্ষক রয়েছেন সেখান থেকে এক জনকে পাশের স্কুলে বহাল করে সমস্যা মেটানোর নিদানও দিয়েছেন অনেকে। যদিও এ বিষয়ে রাজ্য স্কুল শিক্ষা দফতরের সাফ কথা, বর্তমান আইনে এটা সম্ভব নয়। ফলে দিনের পর দিন এ ভাবেই আইনের যাঁতাকলে পড়ে ব্যাহত হচ্ছে পঠনপাঠন।
—নিজস্ব চিত্র।