সদ্যোজাত কন্যাকে খুন করে ফেলে দিল বাবা

কন্যাসন্তান তার প্রয়োজন নেই। তাই মায়ের কোল থেকে ছিনিয়ে নিয়ে সদ্যোজাত মেয়েকে গলা টিপে শ্বাসরোধ করে খুন করার পরে কাপড়ে জড়িয়ে গঙ্গার পাড়ে ঝোপে ফেলে দিয়ে আসার অভিযোগ উঠল বাবার বিরুদ্ধে। মঙ্গলবার বেলুড়ের এই ঘটনায় হতবাক এলাকার বাসিন্দারা।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৬ নভেম্বর ২০১৪ ০১:৫৩
Share:

এই সেই মেয়ে ‘খুন’ করা বাবা, সুব্রত চট্টোপাধ্যায়। —নিজস্ব চিত্র।

কন্যাসন্তান তার প্রয়োজন নেই। তাই মায়ের কোল থেকে ছিনিয়ে নিয়ে সদ্যোজাত মেয়েকে গলা টিপে শ্বাসরোধ করে খুন করার পরে কাপড়ে জড়িয়ে গঙ্গার পাড়ে ঝোপে ফেলে দিয়ে আসার অভিযোগ উঠল বাবার বিরুদ্ধে। মঙ্গলবার বেলুড়ের এই ঘটনায় হতবাক এলাকার বাসিন্দারা। পুলিশ জানায়, বুধবার দুপুরে গ্রেফতার করা হয়েছে অভিযুক্ত সুব্রত চট্টোপাধ্যায়কে। বেলুড়ের রামলোচন সাহা স্ট্রিটের বাসিন্দা ওই ব্যক্তি চটকলের শ্রমিক।

Advertisement

সুব্রতবাবুর প্রতিবেশী সর্বাণী রায় নামে এক মহিলা জানিয়েছেন, মঙ্গলবার রাত ন’টা নাগাদ পাশের বাড়ি থেকে সদ্যোজাতের কান্নার আওয়াজ পান তিনি। কিছুক্ষণ পরেই কানে আসে মেয়েকে গঙ্গায় ফেলে দিয়ে আসার কথা বলছে সুব্রত। আচমকা ওই শিশুর কান্না থেমে যায়। তখন দুঃস্বপ্নেও ভাবতে পারেননি কী মর্মান্তিক ঘটনা ঘটতে চলেছে।

এর পরে প্রায় এক ঘণ্টা আর কোনও কান্নার শব্দ না পেয়ে প্রায় রাত দশটা নাগাদ পাড়ার লোকেদের বিষয়টি জানান সর্বাণীদেবী। সব শুনে এলাকার একদল লোক সুব্রতর বাড়িতে চড়াও হন। তাঁদেরই এক জন শান্তনু দে জানান, প্রায় রাত এগারোটা নাগাদ সুব্রতকে ডাকতে গিয়ে তাঁরা দেখেন, একেবারে স্বাভাবিক ভাবেই সকলের সামনে হাজির হয়েছে সে। শান্তনুবাবু বলেন, ‘‘আমরা জানতে চাই, ওর মেয়ে কোথায়। তখন ও অবলীলায় বলে, মরা মেয়ে জন্মেছে।”

Advertisement

এর পরেই বেশ কয়েক জন ওই ব্যক্তিকে মারধর করেন বলে অভিযোগ। এলাকাবাসীদের দাবি, কিছুক্ষণ পরে সুব্রত স্বীকার করে নেয়, সে-ই মেয়েকে গলা টিপে খুন করেছে। খবর দেওয়া হয় বেলুড় থানায়।

পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, রাত বারোটা নাগাদ সুব্রতকে সঙ্গে নিয়ে বাড়ি থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে গঙ্গার পাড় থেকে কাপড়ে মোড়া অবস্থায় ওই শিশুটির দেহ উদ্ধার করা হয়। সুব্রতর স্ত্রী পুতুলদেবীকে ওই রাতেই স্থানীয় টি এস জায়সবাল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

এখানেই শেষ নয়। এ বার ফের সুব্রত পুলিশকে জানায়, মেয়েকে সে খুন করেনি। তার সন্তান মৃত অবস্থায় জন্মেছিল। পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, মঙ্গলবার রাতেই সুব্রতকে আটক করা হয়। কিন্তু কোনও ভাবেই সে খুনের কথা স্বীকার করছিল না।

প্রাথমিক তদন্তে পুলিশ জানতে পারে, মঙ্গলবার সন্ধ্যায় প্রসব-যন্ত্রণা শুরু হয় পুতুলদেবীর। তখন সুব্রত স্থানীয় এক ধাত্রী অর্চনা মণ্ডলকে ডেকে আনে। তাঁরই সহায়তায় রাত সাড়ে আটটা নাগাদ একটি কন্যার জন্ম দেন পুতুলদেবী। পুলিশের বক্তব্য, অর্চনাদেবী তাদের বলেছেন, জন্মের পরে বাচ্চাটিকে তিনিই পরিষ্কার করেন। সে সম্পূর্ণ সুস্থ ছিল। কিন্তু সুব্রত তাঁকে বলে, ‘গঙ্গায় ফেলে দিয়ে আসব। আমার মেয়ের দরকার নেই।’ অর্চনাদেবীর দাবি, তখন তিনি জানান, তাঁর বৌমা নিঃসন্তান। তাই ওই শিশুকন্যাকে তাঁকে দিয়ে দেওয়া হোক। কিন্তু এই প্রস্তাবে রাজি হননি কেউ। এর পরে তিনি ওই বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসেন বলে জানান অর্চনাদেবী। এ কথা জেনে পুলিশ ফের সুব্রতকে জেরা করতে শুরু করে। পুলিশের দাবি, এর পরেই রণে ভঙ্গ দিয়ে খুনের কথা স্বীকার করে সুব্রত।

হাওড়া সিটি পুলিশের এডিসি (নর্থ) শ্রীহরি পাণ্ডে বলেন, “আটক করার পরে জেরায় সুব্রত কন্যাসন্তানকে খুনের কথা স্বীকার করেছে। তার ভিত্তিতেই বুধবার দুপুরে তাঁকে খুনের অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়েছে।”

এ দিন সুব্রতবাবুর বাড়ির সামনে গিয়ে দেখা গেল, জটলা করেছেন প্রতিবেশীরা। তাঁরা জানান, পুতুলদেবী সুব্রতর দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী। প্রথম পক্ষের একটি ১৬ বছরের ছেলে রয়েছে। প্রথম স্ত্রীর সঙ্গে বিচ্ছেদের পরে ছেলেটি সুব্রতর কাছেই থাকে। এরই মধ্যে বছরখানেক আগে পুতুলদেবীর সঙ্গে বিয়ে হয় সুব্রতর। এক বছর আগে তাঁদের একটি পুত্রসন্তানও হয়। মঙ্গলবার পুতুলদেবী মেয়ের জন্ম দেওয়ার পরেই এই ঘটনায় হতবাক গোটা পাড়া। তাঁরা প্রত্যেকেই চাইছেন কঠোর শাস্তি হোক সুব্রতর।

এ দিন হাসপাতালে শুয়ে কাঁদতে কাঁদতে পুতুলদেবী বলেন, “আমার স্বামী মেয়েকে কোল থেকে কেড়ে নিয়ে গলা টিপে খুন করেছে। বারবার বলা সত্ত্বেও শুনল না। আমার চোখের সামনেই ফুটফুটে বাচ্চাটাকে মেরে ফেলল।” এই ঘটনায় চার দিকে সমালোচনার ঝড় উঠেছে। কন্যাসন্তানের হত্যা আটকাতে বিভিন্ন ক্লিনিকে ভ্রূণ পরীক্ষা বেআইনি ঘোষণা করেছে রাজ্য সরকার। তার পরেও এই ঘটনায় নিন্দায় মুখর সকলে।

রাজ্য মহিলা কমিশনের চেয়ারপার্সন সুনন্দা মুখোপাধ্যায় বলেন, “খুবই দুর্ভাগ্যজনক। একবিংশ শতকে এসেও সমাজে মেয়েদের প্রতি এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি কাঙ্ক্ষিত নয়। মেয়েরা প্রতিনিয়ত লড়াই করছে। কিন্তু এ ধরনের কিছু মানুষ বিষিয়ে দিচ্ছে গোটা সমাজকে।”

মনোবিদ নীলাঞ্জনা সান্যাল বলেন, ‘‘ওই ব্যক্তি মানসিক ভাবে অশিক্ষিত ও বিকৃত। তাঁর মধ্যে পশুবৃত্তি রয়েছে। যে একটি মেয়েকে সমস্ত দিক থেকে ভোগ করতে পারে অথচ কন্যাসন্তানকে জন্মের এক ঘণ্টার মধ্যে খুন করে, তার মানসিক অবস্থা শোচনীয়।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন