তথ্যে ঘাটতি, কে ঠেকাবে দুর্ঘটনা!

দুর্ঘটনার হার, প্রবণতা, ভয়াবহতা ও মৃত্যুহারের ভিত্তিতে রাস্তার বিশেষ বিশেষ এলাকাকে ‘ব্ল্যাক স্পট’ তকমা দেওয়া হয়।

Advertisement

চন্দ্রপ্রভ ভট্টাচার্য

কলকাতা শেষ আপডেট: ০১ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ০৫:৫৭
Share:

দুর্ঘটনাগ্রস্ত সেই বাস। নিজস্ব চিত্র।

‘সেফ ড্রাইভ, সেভ লাইফ’ বা ‘সামলে চালাও, জান বাঁচাও’-এর মতো প্রচার চালিয়ে দুর্ঘটনা অনেক কমানো গিয়েছে বলে দাবি রাজ্য সরকারের। অথচ কেন্দ্রে দুর্ঘটনার তথ্য পাঠানোর ক্ষেত্রে পদে পদে প্রকট হয়ে পড়ছে বাংলার ব্যর্থতা। এবং সেই ব্যর্থতা দুর্ঘটনা প্রতিরোধের উদ্যোগেও ছায়া ফেলছে বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত।

Advertisement

কেন্দ্রের কাছে বিভিন্ন রাজ্যের পাঠানো তথ্যের ভিত্তিতে বড় রাস্তায় অতি দুর্ঘটনাপ্রবণ এলাকা চিহ্নিত করা হয়। প্রশাসনিক পরিভাষায় ওই সব এলাকারই নাম ‘ব্ল্যাক স্পট’। বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, নিরাময়ের আগে রোগ শনাক্ত করার মতো কোন সড়কের কোথায় কোথায় বেশি দুর্ঘটনা ঘটে, সেটা যথাসময়ে চিহ্নিত করতে পারলে তবেই দুর্ঘটনা ঠেকানোর ব্যবস্থা করা যেতে পারে। বিভিন্ন রাজ্যের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে সড়কের ব্ল্যাক স্পট চিহ্নিত করা হয়। সেই চিহ্নিতকরণের জন্য সব রাজ্যের তরফে যথাসময়ে দুর্ঘটনার যাবতীয় তথ্য পাঠানো জরুরি। সেই সব তথ্য যাচাই করে দুর্ঘটনা প্রতিরোধে সংশ্লিষ্ট ‘স্পট’-এর প্রয়োজনীয় পরিকাঠামো উন্নয়নে টাকা দেয় কেন্দ্র। কিন্তু রাজ্যে সেই ব্ল্যাক স্পট চিহ্নিতকরণই থমকে ছিল প্রায় গোটা একটা বছর!

প্রশাসনিক সূত্রের খবর, ২০১৭ সালে রাজ্যের তত্ত্বাবধানে থাকা ১৭০০ কিলোমিটার জাতীয় সড়কের উপরে একটিও ‘ব্ল্যাক স্পট’ চিহ্নিত করা যায়নি! কেন্দ্রকে ঠিক সময়ে তথ্যই দিতে পারেনি রাজ্য। ন্যাশনাল হাইওয়ে অথরিটি অব ইন্ডিয়া বলছে, ওই বছরে পড়শি ঝাড়খণ্ড একটি রাস্তাতেই ১৬টি নতুন ‘ব্ল্যাক স্পট’ চিহ্নিত করার জন্য তথ্য পাঠিয়েছে।

Advertisement

দুর্ঘটনার হার, প্রবণতা, ভয়াবহতা ও মৃত্যুহারের ভিত্তিতে রাস্তার বিশেষ বিশেষ এলাকাকে ‘ব্ল্যাক স্পট’ তকমা দেওয়া হয়। রাজ্য সড়কে সেটা চিহ্নিত করে রাজ্য সরকার। জাতীয় সড়কে সেই কাজের দায়িত্ব কেন্দ্রীয় সড়ক পরিবহণ ও হাইওয়ে মন্ত্রকের।

‘ব্ল্যাক স্পট’ নির্ধারণের জন্য কেন্দ্র ২০১৭ সালের শুরুতে দুর্ঘটনার তথ্য চেয়েছিল। কিন্তু রাজ্যের পাঠানো রিপোর্ট কেন্দ্রের মাপকাঠিতে ‘খাপ’ না-খাওয়ায় ওই বছর সেপ্টেম্বর নাগাদ ফের তথ্য চেয়ে চিঠি দেয় কেন্দ্র। কিন্তু বছর ঘুরে যাওয়া সত্ত্বেও রাজ্যের তত্ত্বাবধানে থাকা প্রায় ১৭০০ কিলোমিটার রাস্তায় নতুন কোনও ব্ল্যাক স্পট ঘোষণা করা হয়নি। তাই রাজ্যের তথ্য ও রিপোর্ট পাঠানোর সময় নিয়ে প্রশ্ন উঠছে প্রশাসনের অন্দরে। ‘‘সময়ে রিপোর্ট গেলে চিত্রটা হয়তো অন্য রকম হত,’’ বলছেন এক আধিকারিক।

রাজ্যে মোট ২৯০০ কিলোমিটার জাতীয় সড়ক রয়েছে। তার মধ্যে ১২০০ কিলোমিটার দেখভাল করেন জাতীয় সড়ক কর্তৃপক্ষ। তাতে রয়েছে ২৭টি ব্ল্যাক স্পট। রাজ্যের তত্ত্বাবধানে থাকা প্রায় ১৭০০ কিলোমিটার জাতীয় সড়কে ২০১৬ সালের হিসেব অনুযায়ী ‘ব্ল্যাক স্পটে’র সংখ্যা চার। অর্থাৎ ২০১৫-র দুর্ঘটনা-তথ্যের ভিত্তিতে ২০১৬ সালে সংশ্লিষ্ট রাস্তায় চারটি ‘ব্ল্যাক স্পট’ ঘোষণা করেছিল মন্ত্রক। রাজ্যের পরিবহণ দফতরের তথ্য অনুযায়ী রাজ্য সড়কে ব্ল্যাক স্পটের সংখ্যা প্রায় ৬৫।

রাজ্য পুলিশ-প্রশাসন অবশ্য এ ক্ষেত্রে তথ্য-ঘাটতির বিষয়টিকে আমল দিতে রাজি নয়। এডিজি (ট্রাফিক) বিবেক সহায় বলেন, ‘‘সব তথ্যই পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে রিপোর্ট আকারে দেওয়া রয়েছে। শীর্ষ আদালতের নজরদার কমিটি ‘সেফ ড্রাইভ সেভ লাইফ’ কর্মসূচি নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছে।’’

একই সুরে পূর্ত দফতরের এক কর্তার দাবি, নতুন করে ব্ল্যাক স্পট ঘোষণা করার থেকেও গুরুত্বপূর্ণ হল, সেই ধরনের দুর্ঘটনাপ্রবণ এলাকাগুলিতে উপযুক্ত সংস্কার হয়েছে কি না। রাজ্যের তত্ত্বাবধানে থাকা জাতীয় সড়কে আর ব্ল্যাক স্পট নেই বলে জানান তিনি।

ওই কর্তার কথায়, ‘‘উপযুক্ত পরিকাঠামোগত সংস্কারের কারণেই ব্ল্যাক স্পট আর নেই। সাম্প্রতিক অতীতে সেখানে দুর্ঘটনায় মৃত্যুও হয়নি। প্রশাসন প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ করছে। বাকিটা নির্ভর করছে সাধারণ মানুষের সচেতনতার উপরে।’’

রাজ্য সরকার যা-ই বলুক, বিশেষজ্ঞেরা মনে করেন, দুর্ঘটনার কারণ, প্রকৃতি এবং প্রবণতা বুঝে বাড়তি নজরদারি চালিয়ে প্রশাসনিক স্তরে পরিকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য এই ধরনের চিহ্নিতকরণ জরুরি। নতুন ‘ব্ল্যাক স্পট’ চিহ্নিত হলে রাজ্যের উদ্যোগের ব্যাপ্তি বাড়তে পারত বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞেরা।

রাজ্যের তত্ত্বাবধানে থাকলেও সংশ্লিষ্ট জাতীয় সড়কের ‘ব্ল্যাক স্পট’ সংস্কারের জন্য অর্থ দেয় কেন্দ্র। প্রকল্পের নির্দিষ্ট প্রস্তাব এবং রূপরেখা পাঠালে কেন্দ্র সেটা খতিয়ে দেখে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ করে।

ব্ল্যাক স্পট কী

দুর্ঘটনা রুখতে রাস্তার বিশেষ বিশেষ অংশকে ‘ব্ল্যাক স্পট’ বা অতি দুর্ঘটনাপ্রবণ বলে চিহ্নিত করা হয়। দুর্ঘটনার হার, প্রবণতা, ভয়াবহতা ও মৃত্যুহারের উপরে এই চিহ্নিত করার কাজটা অনেকাংশে নির্ভর করে। রাস্তার কোনও মোড়, বাঁক বা দুর্ঘটনাপ্রবণ টানা কিছুটা অঞ্চলকে ‘ব্ল্যাক স্পট’ ঘোষণা করা হতে পারে। সেখানে পরিকাঠামোগত সংস্কারের মাধ্যমে দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চালানো হয়। ব্ল্যাক স্পটে এখন বাড়তি নজর দিচ্ছে কেন্দ্র ও রাজ্য।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন