Abhishek Banerjee Gyanesh Kumar

‘জ্ঞানেশ আঙুল তুলেছেন, ওঁকে বলেছি, আঙুল নামিয়ে কথা বলুন! আপনি মনোনীত, আমি নির্বাচিত’, রণং দেহি অভিষেক

বুধবার অভিষেকের সঙ্গেই তৃণমূলের প্রতিনিধি দলে ছিলেন রাজ্যসভার সাংসদ ডেরেক ও’ব্রায়েন, ঋতব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়, সাকেত গোখলে, মমতাবালা ঠাকুর, নাদিমুল হক, লোকসভার সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়, রাজ্যের তিন মন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য, মানস ভুঁইয়া এবং প্রদীপ মজুমদার।

Advertisement

আনন্দবাজার ডট কম সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ৩১ ডিসেম্বর ২০২৫ ১৯:০৯
Share:

(বাঁ দিকে) জ্ঞানেশ কুমার, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় (ডান দিকে)। ছবি: সংগৃহীত।

এতদিন লড়াই চলছিল দূর থেকে। এ বার তৃণমূল তথা অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে ‘মুখোমুখি’ লড়াই বেধে গেল মুখ্য নির্বাচন কমিশনার জ্ঞানেশ কুমারের। বুধবার নয়াদিল্লির নির্বাচন সদনে তৃণমূলের প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বৈঠকের যে বিবরণ বৈঠকের পরে অভিষেক দিয়েছেন, তাতে সেই বিষয়টি স্পষ্ট।

Advertisement

তৃণমূলের প্রতিনিধিদলের একাধিক সদস্যের বক্তব্য, পরিস্থিতি যে এতটা গরম হবে, তা তাঁদের ধারণার মধ্যে ছিল না। বৈঠক এত দীর্ঘ হবে, সেই আন্দাজও ছিল না। কয়েক জন সাংসদ তাই সন্ধ্যার কলকাতার উড়ানের টিকিট কেটে রেখেছিলেন। তাঁদের কার্যত পড়িমরি করে বিমানবন্দরে ছুটতে হয়।

আড়াই ঘন্টা বৈঠকের পর বেরিয়ে দৃশ্যতই উত্তেজিত অভিষেক বলেন, ‘‘জ্ঞানেশ কুমার একাই কথা বলেছেন। আরও দু’জন কমিশনার ছিলেন। তাঁরা রা কাড়েননি। আমরা বলা শুরু করতেই থামিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছিল। উঁচুগলায় কথা বলে আমার দিকে আঙুল তোলেন (জ্ঞানেশ)। আমি তখন বলি, আঙুল নামিয়ে কথা বলুন। আপনি কিন্তু মনোনীত। আমি জনগণের দ্বারা নির্বাচিত। ভাববেন না, আপনি জোর গলায় কথা বললেই আমরা দমে যাব।’’

Advertisement

নির্বাচন সদনে স্মারকলিপি জমা দিতে যাচ্ছে তৃণমূলের প্রতিনিধিদল। ছবি: ফেসবুক থেকে।

তৃণমূলের এক সাংসদের দাবি, বৈঠকে অভিষেক সরাসরি জ্ঞানেশকে ‘বিজেপির দালাল’ বলে আক্রমণ শানিয়েছেন। তোলা হয়েছে এসআইআর আতঙ্কে মৃত্যুর পরিসংখ্যানও। সূত্রের খবর, সেই প্রশ্নে জ্ঞানেশ বলেন, তিনি ওই বিষয়ে অবহিত। তাঁর হাতে রক্ত লেগে রয়েছে বলে যে প্রচার চলছে, তা-ও তাঁর কানে গিয়েছে বলে জ্ঞানেশ বৈঠকে মন্তব্য করেছেন।

সাধারণত সংবাদমাধ্যমের সামনে অভিষেক খুব একটা উত্তেজিত হন না। কিন্তু বুধবার নির্বাচন সদনের সামনে উত্তেজনা গোপন করেননি তৃণমূলের লোকসভার দলনেতা। বস্তুত, জ্ঞানেশকে খোলাখুলি চ্যালেঞ্জও জানিয়েছেন তিনি। জ্ঞানেশ তাঁদের তোলা ১০টি প্রশ্নের মধ্যে দু’তিনটির বেশি জবাব দিতে পারেননি জানিয়ে অভিষেক বলেছেন, ‘‘আমি নির্বাচন সদনের সামনে দাঁড়িয়ে বলছি, উনি পারলে নেমে এসে বলুন, আমরা যা বলছি, তা ঠিক নয়। আমি ঠিক বলছি কি না, তা কমিশন জানাক। ক্ষমতা থাকলে আড়াই ঘণ্টার সিসিটিভি ফুটেজ প্রকাশ করুক! পশ্চিমবঙ্গের মানুষ ওদের দাসত্ব করবে না। আবার চ্যালেঞ্জ করছি, ২০২১ আর ২০২৪ সালে যে ভাবে হারিয়েছি, ২০২৬ সালেও সে ভাবেই বিজেপি-কে হারাব। যত শক্তি প্রয়োগ করার করে নিক!’’ ঘটনাচক্রে, জ্ঞানেশ ছিলেন কেন্দ্রীয় সমবায় সচিব। যে মন্ত্রকের দায়িত্বে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। অভিষেকের অভিযোগ, সেই ‘সূত্রেই’ কলকাঠি নাড়া হচ্ছে।

পশ্চিমবঙ্গে এসআইআরের কাজে গুজরাতের একটি বেসরকারি সংস্থা কাজ করছে বলে জ্ঞানেশের কাছে সরাসরি অভিযোগ জানান অভিষেক। তৃণমূলের দাবি, জ্ঞানেশ জানান, এমন হওয়ার কথা নয়। তখন পাল্টা অভিষেক তাঁকে জানিয়ে দেন, তিনি দরকারে সমস্ত তথ্যপ্রমাণ পাঠিয়ে দেবেন। সে ক্ষেত্রে কি তিনি রাজ্যের মুখ্য নির্বাচনী আধিকারিক মনোজ আগরওয়ালকে শো কজ় করবেন? তৃণমূল সূত্রের খবর, অভিষেক যে সংস্থাটির কথা বলছেন, সেটি গুজরাতের একটি তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থা। রাজ্যের শাসকদলের প্রথম সারির অনেকেরই দাবি, ওই সংস্থার মাধ্যমেই বিভিন্ন আইডি-পাসওয়ার্ড ব্যবহার ‘বৈধ’ করে নাম বাদ দেওয়ার ‘খেলা’ শুরু হয়েছে।

প্রসঙ্গত, এক মাস আগে দিল্লিতে কমিশনের দ্বারস্থ হয়ে তৃণমূল পাঁচটি প্রশ্ন তুলেছিল। বুধবার প্রশ্নের সংখ্যা ছিল তার দ্বিগুণ— ১০টি। ১ কোটি ৩৬ লক্ষের নামের তালিকা প্রকাশ কেন হচ্ছে না, ভোটার তালিকায় রোহিঙ্গা এবং বাংলাদেশির সংখ্যা কত, শুনানিতে প্রবীণ নাগরিকদের বাড়িতে যাওয়া, আতঙ্কে মৃত্যুর দায়, বিএলএদের উপস্থিতি কেন নয়, সফটওয়্যারের ভূমিকা, লিখিত নির্দেশিকা না-দিয়ে হোয়াটস্‌অ্যাপে নোট চালাচালি, পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য ভার্চুয়াল শুনানির মতো মোট ১০টি প্রশ্ন তোলা হয় তৃণমূলের তরফে। বিকাল পৌনে ৪টে নাগাদ তৃণমলের স্মারকলিপিটি আনুষ্ঠানিক ভাবে গ্রহণ করে সিলমোহর দেয় কমিশন।

গত শনিবার থেকে এসআইআরের শুনানি প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। প্রাথমিক পর্বে দলীয় কর্মীদের উদ্দেশে অভিষেকের নির্দেশ ছিল, কমিশনের নিযুক্ত বিএলও-দের ছায়াসঙ্গী হয়ে থাকতে হবে। দ্বিতীয় দফায় অর্থাৎ, শুনানি প্রক্রিয়ায় সংঘাতের ইঙ্গিত দিয়েছিলেন অভিষেক। বুধবার জ্ঞানেশকেও তিনি বলে এসেছেন, লিখিত নির্দেশিকা জারি না-হলে শুনানিকেন্দ্রের ভিতর বিএলএ থাকবেই। রবিবারই সাংগঠনিক বৈঠক করে অভিষেক নির্দেশ দিয়েছিলেন, শুনানিতে বিএলএ-দের প্রবেশাধিকার দিচ্ছে না কমিশন। কিন্তু দলের বিএলএ-দের সেখানে পৌঁছতেই হবে। অভিষেকের বেঁধে দেওয়া সংঘাতের সুরে সোমবার থেকেই দেখা যায়, তৃণমূল বিএলএ-দের শুনানিকেন্দ্রে প্রবেশাধিকারের দাবিতে প্রতিরোধ শুরু করেছে। একাধিক জায়গায় বন্ধ হয়ে যায় শুনানি।

বুধবারেও কমিশনের সামনে সেই প্রসঙ্গ তোলেন তৃণমূলের প্রতিনিধিরা। বৈঠকের পরে অভিষেকের দাবি, ‘‘জ্ঞানেশ বলেছেন, বিএলএ-দের প্রবেশাধিকার দেওয়া যাবে না। আমরা প্রশ্ন করি, কেন দেওয়া যাবে না? ভোটের দিন, গণনার সময়, এসআইআরের প্রথম ধাপে বিএলএ থাকতে পারলে শুনানিতে থাকবে না কেন? তখন কমিশন বলে, তারা অনুমতি দেবে না। আমরা বলি, সেই মর্মে লিখিত বিজ্ঞপ্তি দিন। ওরা বলে, তা-ও দেবে না। সেটা শুনে আমরা বলে এসেছি, লিখিত না দিলে শুনানিতে বিএলএ থাকবেই।’’ অর্থাৎ, বাধা দিলে সংঘাতের বার্তা আরও এক বার স্পষ্ট করে দিয়েছেন অভিষেক। তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদকের বক্তব্য, কমিশন ভেবেচিন্তেই এ বিষয়ে লিখিত নির্দেশিকা দিচ্ছে না। তাঁর কথায়, ‘‘ওরা জানে লিখিত কিছু দিলেই তা আদালতে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে। সে কারণেই অধিকাংশ বিষয় হোয়াটস্‌অ্যাপের মাধ্যমে করছে। কারণ, তার আইনে কোনও বৈধতা নেই।’’

এসআইআরের প্রাথমিক পর্বে পশ্চিমবঙ্গে ৫৮ লক্ষের সামান্য বেশি সংখ্যক নাম বাদ গিয়েছে। গত ১৬ ডিসেম্বর কমিশন খসড়া তালিকা প্রকাশ করে। সে দিনই কমিশনের তরফে জানানো হয়, আরও ১ কোটি ৩৬ লক্ষ মানুষের নথি যাচাই করা হবে। অভিষেকের প্রশ্ন, ‘‘কোন জাদুকাঠির বলে খসড়া তালিকা প্রকাশের দিনই কমিশন জেনে গেল যে ১ কোটি ৩৬ লক্ষ মানুষের নাম ‘লজিক্যাল ডিসক্রিপেন্সি’র তালিকায় থাকছে? এসআইআর করতে দেড় মাস লাগল। তাতে কাজ করলেন প্রায় এক লক্ষ মানুষ। আর এক দিনে কমিশন ‘লজিক্যাল ডিসক্রিপেন্সি’র সংখ্যা জেনে গেল? কী ভাবে?’’ অভিষেকের দাবি, এ হেন নানাবিধ প্রশ্নের জবাবই দিতে পারেননি জ্ঞানেশ। অভিষেকের এ-ও প্রশ্ন যে, এই ১ কোটি ৩৬ লক্ষ মানুষ কারা, তার পূর্ণাঙ্গ তালিকা কেন কমিশন প্রকাশ করছে না? তাঁর দাবি, ‘‘এখানেই ভোটচুরির চাবিকাঠি লুকিয়ে রয়েছে।’’ অতীতের এসআইআর প্রসঙ্গ টেনে অভিষেক বলেন, ‘‘এর আগে যখন এসআইআর হয়েছিল, তখন কোনও সন্দেভাজনদের তালিকা তৈরি হয়নি। এ বার করা হয়েছে। আমরা জানতে চেয়েছি, এই তালিকা কে করল? কার নির্দেশে হল? কোনও উত্তর দিতে পারেনি।’’

পশ্চিমবঙ্গ ছাড়া গুজরাত, তামিলনাড়ু, কেরল, উত্তরপ্রদেশ, ছত্তীসগঢ়ের মতো রাজ্যেও এসআইআর হচ্ছে। সেখানে নাম বাদের হার পশ্চিমবাংলার তুলনায় বেশি। তা-ও কেন এ রাজ্যেই ‘মাইক্রো অবজার্ভার’ নিয়োগ করা হচ্ছে, সেই প্রশ্নও বৈঠকে তোলেন অভিষেক। কমিশনের তরফে বলা হয়, রাজ্য সরকার পর্যাপ্ত আধিকারিক দিচ্ছে না। তাই ‘মাইক্রো অবজার্ভার’ নিয়োগ করা হয়েছে। পাল্টা অভিষেক বলেন, রাজ্যের অসংখ্য অফিসারকে বসিয়ে রাখা হয়েছে। সেই তালিকাও তুলে দেওয়া হয়েছে জ্ঞানেশের হাতে।

তৃণমূলের তরফে বৈঠকে প্রশ্ন তোলা হয়, রাজ্যের বদনাম করার জন্য ধারাবাহিক ভাবে বলা হচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গে ১ কোটি রোহিঙ্গা এবং বাংলাদেশি রয়েছে। কমিশন কেন তাদের তালিকা প্রকাশ করছে না? তেমন কোনও বিষয় না-থাকলে কেন বিজেপির বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করছে না?

অভিষেক অভিযোগ করেছেন, এইআরও-দের ‘লগ ইন’ থেকে কারসাজি করা হচ্ছে। যাঁদের ক্ষেত্রে সিস্টেমে ‘ফাউন্ড ওকে’ দেখাচ্ছে, তার পরে তাঁদের নামেই শুনানির নোটিস জারি হচ্ছে। এ ব্যাপারে কমিশন অ্যাপের কারিগরি ত্রুটির কথা স্বীকার করে নিয়েছে বলেও দাবি করেছেন তিনি। ৬০ বছরের বেশি বয়সিদের সকলের জন্য বাড়ি গিয়ে শুনানিরও দাবি জানানো হয়েছে। তৃণমূলের দাবি, কমিশন বলেছে, বিষয়টি তারা ভেবেচিন্তে দেখবে। বুধবার অভিষেকের সঙ্গেই কমিশনের সঙ্গে বৈঠকে গিয়েছিলেন রাজ্যসভার দলনেতা ডেরেক ও’ব্রায়েন, ঋতব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়, সাকেত গোখলে, মমতাবালা ঠাকুর, নাদিমুল হক। ছিলেন লোকসভার সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং রাজ্যের তিন মন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য, মানস ভুঁইয়া ও প্রদীপ মজুমদার।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement
Advertisement