জমি-জেদেই লোকসান

হাতের কয়লা পায়ে ঠেলল রাজ্য

আক্ষরিক অর্থেই সোনার খনি। হাতের নাগালে থাকতেও যার ফসল নিজের ঘরে তোলার সুযোগ হেলায় হারিয়েছে পশ্চিমবঙ্গ। বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে সেই জমি-নীতি। খনির নাম দামাগোড়িয়া-চাপতোড়িয়া (পূর্ব)। বর্ধমানের কুলটিতে উন্নতমানের কয়লাসমৃদ্ধ এলাকায় সেটি চালু করার জন্য সাকুল্যে ২৩৭ একর জমি অধিগ্রহণের দরকার ছিল। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার রাজি হয়নি।

Advertisement

সুশান্ত বণিক

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৪ অগস্ট ২০১৪ ০৩:১৪
Share:

ছবি: শৈলেন সরকার।

আক্ষরিক অর্থেই সোনার খনি। হাতের নাগালে থাকতেও যার ফসল নিজের ঘরে তোলার সুযোগ হেলায় হারিয়েছে পশ্চিমবঙ্গ। বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে সেই জমি-নীতি।

Advertisement

খনির নাম দামাগোড়িয়া-চাপতোড়িয়া (পূর্ব)। বর্ধমানের কুলটিতে উন্নতমানের কয়লাসমৃদ্ধ এলাকায় সেটি চালু করার জন্য সাকুল্যে ২৩৭ একর জমি অধিগ্রহণের দরকার ছিল। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার রাজি হয়নি। ফলে কেন্দ্রীয় সংস্থা ভারত কোকিং কোল লিমিটেড (বিসিসিএল) খনিটির দায়িত্ব নিয়ে এখন সেখান থেকে কার্যত সোনা তুলছে। রাজ্য সরকারকে সন্তুষ্ট থাকতে হচ্ছে স্রেফ সেস নিয়ে।

প্রশাসনের তথ্য বলছে, দামাগোড়িয়া-চাপতোড়িয়ার সুবাদে রাজ্য সরকার প্রায় ১৫ কোটি টন কয়লার ভাণ্ডার হাতে পেতে পারত। কয়লার অভাবে যেখানে তাপ-বিদ্যুতের ইউনিট বসে যাওয়া নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা, সেখানে এটা মস্ত সুরাহা হয়ে উঠত। পাশাপাশি বাড়তি কয়লা পছন্দের জায়গায় বেচে দিয়ে কোষাগারে বাড়তি আয়েরও বিস্তর সুযোগ ছিল। বস্তুত বিদ্যুৎ ও ইস্পাত উৎপাদনের এই আবশ্যকীয় কাঁচামালটি খনি থেকে তোলার অধিকার আদায়ের জন্য রাজ্যে-রাজ্যে টক্কর চলে। অথচ পশ্চিমবঙ্গ সরকার জমি অধিগ্রহণ না-করার পণ ধরে থেকে যে ভাবে নিজেকে বঞ্চিত করেছে, সরকারির অফিসারদের অনেকেই তা দেখে হতাশ।

Advertisement

বিসিসিএল-সূত্রের খবর: কুলটির চাঁচ-ভিক্টোরিয়ায় তাদের যে ‘মাইন এলাকা,’ সেখানে গ্রেটার কল্যাণেশ্বরী নামে একটি বড় খোলামুখ খনি তৈরির প্রস্তাব উঠেছিল বিগত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকে। স্থির হয়, মোট ন’টি মৌজার কয়েকশো একর জুড়ে প্রকল্পটি গড়ে তোলা হবে। পরে বিসিসিএলের সমীক্ষায় ধরা পড়ে, ওই তল্লাটে কয়েক কোটি টন কয়লা মজুত রয়েছে। তাই একটার বদলে তিনটে খোলামুখ খনির পরিকল্পনা হয়। প্রথমটি কাজ শুরু করে বড়িরায়, ২০০২-এ সেখানে উত্তোলন শেষ হয়েছে। দ্বিতীয়টি দামাগোড়িয়া। খাতায়-কলমে সেটি এখনও চালু থাকলেও ২০০৯-এ কয়লা তোলা বন্ধ হয়েছে। আর তৃতীয়টি হল এই দামাগোড়িয়া-চাপতোড়িয়া কয়লাখনি। যেখানে প্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকার কয়লা সঞ্চিত রয়েছে বলে বিসিসিএল-সূত্রের দাবি।

কিন্তু তার অধিকার পশ্চিমবঙ্গ সরকার পেত কীসের ভিত্তিতে?

বিসিসিএলের এক মুখপাত্র জানাচ্ছেন, তৃতীয় খনিটির জন্য কয়লা মন্ত্রকের অনুমোদন ও ডিরেক্টর জেনারেল অব মাইন্স সেফ্টি (ডিজিএমএস)-র ছাড়পত্র যত দিনে সংস্থার হাতে আসে, তত দিনে কাটোয়ায় প্রস্তাবিত তাপ-বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য কয়লা সংস্থানের লক্ষ্যে খনি বরাদ্দের আবেদন সেরে ফেলেছিল রাজ্যের তদানীন্তন বাম সরকার। সেই মতো নয়াদিল্লি ২০০৯-এ দামাগোড়িয়া-চাপতোড়িয়া ব্লকটি পশ্চিমবঙ্গের জন্য বরাদ্দ করে।

কিন্তু পরিস্থিতি পাল্টে যায় ২০১১-য়, রাজ্যে পালাবদলের পরে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নতুন সরকার কয়লা মন্ত্রককে জানিয়ে দেয়, ওই কোল ব্লক রাজ্য নেবে না। কারণ, ওখানে খনি চালু করতে হলে গ্রামবাসীদের কাছ থেকে জমি অধিগ্রহণ করতে হবে, যা রাজ্য সরকারের নীতি-বিরোধী। ফলে ২০১১-র শেষের দিকে কোল ইন্ডিয়া মারফৎ ফের বিসিসিএলের হাতেই ফিরে আসে দামাগোড়িয়া-চাপতোড়িয়া কোল ব্লক। সেখানে ২৩৭ একর জমি জুড়ে তারা খোলামুখ খনি তৈরির পরিকল্পনা চূড়ান্ত করে। যে কৃষকদের থেকে জমি নেবে না বলে রাজ্য সরকার প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছে, তাঁদের থেকেই বিসিসিএল জমি কিনতে উদ্যোগী হয়। মালিকেরা সংস্থাকে জানিয়ে দেন, পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ পেলে জমি দিতে তাঁদের আপত্তি নেই। রাজ্যের ভূমি দফতর জমির দর ঠিক করে দেয় একরপিছু গড়ে আট লাখ টাকা। সঙ্গে কয়লা মন্ত্রকের নিয়ম মেনে দু’একর জমিপিছু পরিবারের এক জনের চাকরি।

জমি কেনার পর্ব মিটে যায় নির্বিঘ্নে। কেনা হয় মূলত ডাঙা জমি, যেখানে চাষ-আবাদের বালাই নেই বললেই চলে। বাসিন্দাদের বক্তব্য, আশপাশের বিভিন্ন কয়লাখনির দূষণের কারণে এখানকার জমি চাষবাসের বিশেষ উপযুক্ত নয়। তাঁরা তাই সাগ্রহে জমি বেচেছেন। “বিসিসিএলের বদলে রাজ্য সরকার যদি জমি কিনত, তাদেরও দিতাম।” বলছেন ওঁরা। বিসিসিএল-সূত্রের খবর, এ পর্যন্ত ১৭০ একর কেনা হয়ে গিয়েছে। ২০১২-য় খননের কাজও শুরু হয়েছে পুরোদমে।

এবং ঝিমিয়ে থাকা গোটা এলাকাটা যেন বদলে গিয়েছে জাদুকাঠির ছোঁয়ায়! কী রকম?

গিয়ে দেখা গেল, কর্মযজ্ঞ চলছে। শ’চারেক লোক খনিমুখ ও ওয়ার্কশপে কাজ করছেন, অনেকে স্থানীয়। খনি ঘিরে দোকান, বেচা-কেনা। “বড়িরা খনি বন্ধ হওয়ার পরে পুরো জায়গাটা শ্মশান হয়ে গিয়েছিল। ফের চাঙ্গা হয়ে উঠেছে।” বলেন কোলিয়ারির ইঞ্জিনিয়ার তাপস চট্টোপাধ্যায়। আর এক ইঞ্জিনিয়ার জগজিৎ সরকারের মন্তব্য, “প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কর্মসংস্থান বেড়েছে। আশপাশের ছোটখাটো কারখানাগুলো সহজে কয়লা পাচ্ছে। তাতে এলাকারই উন্নতি হচ্ছে।” খনিতে কাজ পেয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দা বাবন মুখোপাধ্যায়, গৌতম গড়াইরা। তাঁরা বলেন, “পাথুরে জমিতে চাষ হতো না। তার বদলে টাকা পেয়েছি, চাকরিও। অনেক লাভ।” কোলিয়ারি কর্তৃপক্ষের দাবি: দামাগোড়িয়া-চাপতোড়িয়ার দৌলতে প্রায় বারোশো পরিবার উপকৃত হয়েছে।

ব্যবসা দেখে খুশি খনি-কর্তৃপক্ষও। ম্যানেজার অভিজিৎ ঘোষ, এজেন্ট চন্দন বন্দ্যোপাধ্যায়েরা জানিয়েছেন, এখানে তোলা কয়লার ৮০% যাচ্ছে বক্রেশ্বর, দুর্গাপুর-সহ রাজ্যের বিভিন্ন তাপ-বিদ্যুৎকেন্দ্রে। সেটা মূলত উন্নতমানের ‘নন-ওয়াশারি’ কয়লা। বাকি ‘ওয়াশারি’ কয়লা শোধন করে পাঠানো হচ্ছে বিভিন্ন ইস্পাত কারখানায়। দাম স্থির হচ্ছে ই-টেন্ডারের মাধ্যমে। বিসিসিএলের চাঁচ-ভিক্টোরিয়া এরিয়ার জেনারেল ম্যানেজার বিজয়চন্দ্র নায়েকের সংক্ষিপ্ত মন্তব্য, “খনি ভাল চলছে। গ্রামবাসীরা যত বেশি সহযোগিতা করবেন, তত ভাল চলবে। সকলে উপকৃত হবেন।” রাজ্যের প্রাক্তন এক বিদ্যুৎ-কর্তা জানিয়েছেন, দামাগোড়িয়া-চাপতোড়িয়ায় যা কয়লা আছে, তার অর্ধেকের বেশি কোকিং কয়লা। বাকি নন-কোকিং। খোলামুখ খনি হওয়ায় উৎপাদন খরচও অনেক কম।

“সোনার সুযোগ হেলায় হারিয়েছি আমরা।” আক্ষেপ করছেন তিনি।

খনির নাম: দামাগোড়িয়া-চাপতোড়িয়া

প্রয়োজনীয় জমি: ২৩৭ একর

এ পর্যন্ত কেনা হয়েছে: ১৭০ একর

জমির দাম: একরপিছু ৮ লাখ, সঙ্গে পরিবারপিছু এক জনের চাকরি

উপকৃত পরিবারের সংখ্যা: ১২০০

কয়লার পরিমাণ: ১৫ কোটি টন

আনুমানিক দাম: ৬০ হাজার কোটি টাকা

রাজ্যের প্রাপ্তি: শুধুই সেস

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন