SIR in West Bengal

২৮ অক্টোবর থেকে ২৮ নভেম্বর, এক মাসে বঙ্গে ‘এসআইআর ঘটিত’ মৃত্যু ৩৩, আত্মঘাতী ১৮! যত মৃত্যুতে কাঠগড়ায় কমিশন

জাতীয় ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরো (এনসিআরবি)-র রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০২৩ সালে পশ্চিমবঙ্গে আত্মহত্যা করেছিলেন ১২,৮১৯ জন। যা তার আগের বছরের তুলনায় ৬৯১ জন কম। বাংলায় আত্মহত্যার দৈনিক গড় ৩৫।

Advertisement

সৈকত দাস

শেষ আপডেট: ২৮ নভেম্বর ২০২৫ ১৭:২৯
Share:

গ্রাফিক: আনন্দবাজার ডট কম।

এসআইআর ঘোষণার ৩১ দিনের মধ্যে রাজ্যে ৩৩টি মৃত্যু! নেপথ্যে দায়ী করা হচ্ছে এসআইআরের ‘আতঙ্ক এবং কাজের চাপ’কে। ভোটার তালিকার বিশেষ নিবিড় সংশোধনের পর নাম থাকবে কি না, সে নিয়ে আতঙ্কে অনেকে চরম পদক্ষেপ করেছেন বলে দাবি। তেমনই কর্তব্যরত দুই বুথ স্তরের আধিকারিকের আত্মহত্যার কারণ হিসাবে এসআইআরের কাজের চাপকে দায়ী করা হয়েছে। এ নিয়ে নির্বাচনের কমিশনের প্রতিক্রিয়া চেয়েও মেলেনি বলে অভিযোগ রাজ্যের শাসকদল তৃণমূলের।

Advertisement

বাংলায় এসআইআর চালু হয়েছে গত ২৮ অক্টোবর। প্রথম দিনেই আত্মহত্যা করেন প্রদীপ কর নামে উত্তর ২৪ পরগনার খড়দহের বাসিন্দা। ২৮ নভেম্বর, শুক্রবার পর্যন্ত গণনাপত্রের (এনুমারেশন ফর্ম) পূরণ এবং জমা নেওয়ার প্রক্রিয়ার মধ্যে আত্মহত্যা করেছেন ১৮ জন। এঁদের মধ্যে রয়েছেন দুই বিএলও। বাকি ১৫ জনের মৃত্যু হয়েছে হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত হয়ে এবং ব্রেন স্ট্রোকে। মৃতদের পরিবারগুলির দাবি, আশঙ্কা এবং আতঙ্কে ওই পরিণতি। সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয়েছে মুর্শিদাবাদে— ন’জনের। তার পরে রয়েছে দুই মেদিনীপুর এবং দুই ২৪ পরগনা। এসআইআর আতঙ্ক এবং কাজের চাপে মৃত্যুর অভিযোগ উঠেছে হুগলি, দুই দিনাজপুর, হাওড়া, হুগলি এবং জলপাইগুড়ি জেলাতেও।

জাতীয় ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরো (এনসিআরবি)-র রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০২৩ সালে পশ্চিমবঙ্গে আত্মহত্যা করেছিলেন ১২,৮১৯ জন। যা তার আগের বছরের তুলনায় ১৫০ জন বেশি। সারা দেশে আত্মহত্যার পরিসংখ্যানে বাংলা মোটামুটি প্রথম পাঁচেই থাকে। এনসিআরবি-র ২০২৩ সালের তথ্য ধরলে দেশে মোট আত্মহত্যার ৭.৫ শতাংশ হয়েছে বাংলায়। মাসিক আত্মহত্যার গড় ১০৬৮-র আশপাশে। নথি বলছে, পশ্চিমবঙ্গে দিনে প্রায় ৩৫ জন আত্মহত্যা করেন। সেখানে চলতি বছর এসআইআরের কারণে সেই সংখ্যা কোথা গিয়ে দাঁড়াবে, তা সময় বলবে।

Advertisement

এনসিআরবি-র রিপোর্ট বলছে, পশ্চিমবঙ্গে কৃষক আত্মহত্যার সংখ্যা শূন্য। এ রাজ্যে আত্মহত্যার সবচেয়ে বড় কারণ ‘পারিবারিক’। ২০২৩ সালে রাজ্যে পারিবারিক সমস্যার জন্য আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছিলেন ২,৬১০ জন। বিবাহসংক্রান্ত বিবাদে ৬৮৩ জন, পণপ্রথার শিকার হয়ে ১২৮ জন, বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কের কারণে গোলমাল এবং তার জেরে ১৫১ জন আত্মহত্যা করেছে। এ ছাড়াও আত্মহত্যার বিবিধ কারণের কথা বলা হয়েছে রিপোর্টে। আত্মহত্যার কারণ জানা যায়নি ৩,৪৩৬ জনের ক্ষেত্রে। তবে ১.১ শতাংশ মানুষের আত্মহত্যার নেপথ্যে রয়েছে কর্মক্ষেত্রে সমস্যা বা চাকরি হারানোর ভয়ের মতো কারণ। ২০২৩ সালে চাকরিরত অবস্থায় আত্মহত্যা করেন ২.৮ শতাংশ মানুষ। শ্রমিক নন এবং মাসিক বেতন পান এমন ৯.৬ শতাংশ মানুষ আত্মঘাতী হয়েছেন। ২০২৩ সালে সারা দেশে আত্মঘাতী হয়েছিলেন মোট ১ লক্ষ ৭১ হাজার ৪১৮ জন। এর মধ্যে পুরুষের সংখ্যা ১ লক্ষ ২৪ হাজার ৭০০, মহিলার সংখ্যা ৪৬ হাজার ৭১৮। গত এক দশক ধরে দেখা যাচ্ছে মহিলাদের তুলনায় পুরুষদের আত্মহত্যার প্রবণতাই বেশি।

কিন্তু নাগরিকত্ব হারানোর ভয়ে বা ভোটার থাকবেন কি না, সেই আশঙ্কায় আত্মহত্যা নজিরবিহীন। সাম্প্রতিক অতীতে এমন কোনও দৃষ্টান্ত মেলেনি। তেমনই প্রশাসন নির্দেশিত সরকারি কাজ করতে গিয়ে কাজের চাপে আত্মহত্যা কিংবা অসুস্থ হয়ে গিয়ে মারা গিয়েছেন, এমন অভিযোগও অভিনব।

শুধু পশ্চিমবঙ্গেই নয়, দেশের আরও ১১টি রাজ্য এবং কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলেও একই সঙ্গে শুরু হয়েছে এসআইআরের কাজ। যাঁরা কর্মসূত্রে বাইরে থাকেন, তাঁদের জন্য অনলাইনে ‘এনুমারেশন ফর্ম’ পূরণ করার ব্যবস্থা করেছে কমিশন। অন্যান্য রাজ্যেও বিএলও-র মৃত্যুর খবর মিলেছে। তাঁদের অনেকে আত্মহত্যা করেছেন। অল্প সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করার চাপকেই দায়ী করা হচ্ছে সেখানেও। কিন্তু বাংলার মতো এসআইআরের আতঙ্কে সাধারণ মানুষের আত্মহত্যার তথ্য নেই।

তৃণমূলের নেতা অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় ঘোষণা করেছেন, দিল্লির বুকে এসআইআর বিরোধী আন্দোলনে নামবে তৃণমূল। সে জন্য দলের ১০ জন সাংসদকে নিয়ে একটি দল গড়ে দিয়েছেন তিনি। শুক্রবারেই নির্বাচন কমিশনের সদর দফতরে গিয়ে কমিশনের ফুল বেঞ্চের সঙ্গে দেখা করেন ডেরেক ও’ব্রায়েন, কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়, শতাব্দী রায়, দোলা সেন, মহুয়া মৈত্র, প্রকাশ চিক বরাইক, সাজদা আহমেদ, মমতাবালা ঠাকুর, প্রতিমা মণ্ডল এবং সাকেত গোখলে। বৈঠকশেষে তৃণমূলের প্রতিনিধিদলের দাবি, তাদের কোনও প্রশ্নেরই উপযুক্ত জবাব দিতে পারেনি কমিশন। এমনকি, তারা জবাব পায়নি এই প্রশ্নেরও যে, এসআইআরের কারণে মৃত্যুর ‘দায়’ কমিশন নেবে কি না।

মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাজ্যে ভোটার এবং বিএলও-দের মৃত্যু-আত্মহত্যার কারণ দর্শিয়ে এসআইআর স্থগিত রাখার দাবি জানিয়েছেন। গত ২০ নভেম্বর মুখ্য নির্বাচন কমিশনারকে চিঠি লিখেছিলেন তিনি। তাতে কাজের চাপে বিএলও-দের মৃত্যু এবং আত্মহত্যার মতো ঘটনা তুলে ধরে প্রস্তুতির অভাবের কথা বলে এসআইআর স্থগিত রাখার দাবি জানান মুখ্যমন্ত্রী। নির্বাচন কমিশনের শীর্ষকর্তাদের পাল্টা যুক্তি, ইতিমধ্যে পশ্চিমবঙ্গের প্রায় ৭ কোটি ৬৬ লক্ষ ভোটারের মধ্যে ৮২.৯১ শতাংশ বা ৬ লক্ষ ৩৫ হাজারের বেশি ভোটারের গণনাপত্রের ‘ডিজিটাইজ়েশন’ হয়ে গিয়েছে। সময় রয়েছে ৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত। এখন কমিশন মনে করছে, পশ্চিমবঙ্গে সময়ের আগেই যাবতীয় গণনাপত্রের (এনুমারেশন ফর্ম) ‘ডিজিটাইজ়েশন’-এর কাজ শেষ হয়ে যাবে।

অন্য দিকে, শুধু তৃণমূলই নয়, এসআইআরে ১২টি রাজ্যে মোট ২৬ জন বিএলওর মৃত্যুর অভিযোগ তুলে কংগ্রেসের দাবি, এতগুলি মৃত্যুর জন্য প্রধানমন্ত্রী এবং নির্বাচন কমিশন দায়ী। যদিও বিএলও-দের কাজের চাপ নিয়ে কমিশনের এক শীর্ষকর্তার যুক্তি, বিহারেও এক মাসের মধ্যে এসআইআরের কাজ সম্পন্ন হয়েছিল। কিন্তু সেখানে কোনও আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেনি। তাঁর বক্তব্য, সত্যিই কত জন বিএলও এসআইআর-এর কাজের চাপে আত্মহত্যা করেছেন, তা রাজ্যের নির্বাচনী আধিকারিকের রিপোর্ট দেখে বোঝা যাবে। (তথ্য সহায়তা: সারমিন বেগম)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement