Politics

West Bengal Police: ‘প্রভাবশালীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা’র জন্যই কি বাড়ছে থানার দাপট? প্রশ্ন পুলিশকর্তাদের

রাজ্য পুলিশ কর্তাদের একাংশের দাবি, প্রায় প্রতিটি ঘটনায় প্রাথমিক ভাবে স্থানীয় থানার ওসি-র বড়সড় গাফিলতির অভিযোগ উঠেছে।

Advertisement

শুভাশিস ঘটক

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৮ মার্চ ২০২২ ০৭:১২
Share:

ফাইল চিত্র।

‘প্রভাবশালী’ রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীদের সুনজরে থাকায় রাজ্যের বিভিন্ন থানার দায়িত্বে থাকা এক শ্রেণির পুলিশ কর্মীই এখন বেশিরভাগ ঘটনার মূল ‘নিয়ন্ত্রক’ বলে মেনে নিচ্ছেন পুলিশ কর্তাদেরই একাংশ। তাঁদের দাবি, আর সেই কারণেই রাজ্যে এই পরিস্থিতি।

Advertisement

কিছু পুলিশ কর্তার দাবি, হাওড়ার আনিস-কাণ্ড, ঝালদার কংগ্রেস কাউন্সিলর তপন কান্দু, পানিহাটির অনুপম দত্ত ও রামপুরহাটের উপপ্রধান ভাদু শেখের খুন এবং তার পরে প্রতিহিংসার জেরে একের পর এক বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার মতো ঘটনা এত কম সময়ের মধ্যে এর আগে কখনও রাজ্যে ঘটেনি।

রাজ্য পুলিশ কর্তাদের একাংশের দাবি, প্রায় প্রতিটি ঘটনায় প্রাথমিক ভাবে স্থানীয় থানার ওসি-র বড়সড় গাফিলতির অভিযোগ উঠেছে। অথচ, প্রায় প্রতিটি ঘটনাতেই দেখা যাচ্ছে, থানার দায়িত্বে থাকা অফিসারদের তুলনায় ‘লঘু’ সাজা দিয়ে শাস্তি হচ্ছে অন্যদের। হাওড়ার আমতায় আনিস-কাণ্ডে যে ভাবে সিভিক ভলান্টিয়ার এবং হোমগার্ডকে গ্রেফতার করে ওসি-কে ছুটিতে পাঠানো হয়েছে, তা দেখে কার্যত বিস্মিত পুলিশ কর্তারা। তাঁদের দাবি, গঠনতন্ত্র অনুযায়ী ওসি যা করেছেন, তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। অথচ ‘প্রভাবশালীদের’ সঙ্গে ‘ঘনিষ্ঠতা’ থাকায় ওসির বিরুদ্ধে কড়া পদক্ষেপ করা যায়নি বলে অভিযোগ পুলিশেরই একাংশের।

Advertisement

পুরুলিয়ার ঝালদা পুরসভার কংগ্রেস কাউন্সিলর তপন কান্দু খুনের ঘটনায় স্থানীয় থানার আইসি-র ফোনের ‘অডিয়ো রেকর্ডিং’ (যার সত্যতা যাচাই করেনি আনন্দবাজার পত্রিকা) রাজ্যজুড়ে তোলপাড় ফেলে দিয়েছে। তপনের এক আত্মীয়কে তৃণমূলে যোগ দিতে চাপ দিচ্ছেন তিনি, এমনই শোনা গিয়েছে সেই রেকর্ডিংয়ে। পুলিশ কর্তাদের অভিযোগ, এই শ্রেণির অফিসারেরা খোলাখুলি ভাবে যে রাজনীতি করছেন, তা প্রকট হয়েছে ওই ঘটনায়। শাস্তি — শুধুমাত্র থানার দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে তাঁকে।

রামপুরহাট কাণ্ডে ভাদু খুনের ঘটনার মাত্র ঘণ্টাখানেকের মধ্যে একটা গ্রামে একের পর এক বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু পুলিশের কাছে তার কোনও খবর ছিল না, মানতে নারাজ বড় কর্তারা। ভাদুর বাড়ি ওই গ্রামেই। ভাদু প্রভাবশালী। খুনের পরে আশপাশের গ্রাম থেকে বগটুইয়ে মানুষ ছুটে এসেছিল। অথচ পুলিশ ছিল না, এটা কোনও ভাবেই মেনে নেওয়া সম্ভব নয়, বলছেন পুলিশ কর্তারাই। রাজ্য পুলিশের এক কর্তার কথায়, ‘‘এর দায় কার! ওসি-কে সাসপেন্ড করা হয়েছে। কিন্তু, এর ভিতরে বৃহত্তর যড়যন্ত্রের ঈঙ্গিত রয়েছে। সে ক্ষেত্রে তো গ্রেফতার হওয়া উচিত!’’

পুলিশ কর্তাদের অভিযোগ, মূলত রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার সুবাদে কর্তব্যে চূড়ান্ত গাফিলতির ঘটনা ঘটলেও ছাড় পেয়ে যাচ্ছেন কিছু অফিসার। এই তালিকায় জেলার দায়িত্বে থাকা অফিসারেরা কি নেই? সেই প্রশ্নের জবাবে কর্তারা জানাচ্ছেন, হাতে-গোনা কয়েক জন এসপি-র বিরুদ্ধে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে দহরম-মহরমের অভিযোগ থাকলেও সারা রাজ্যের বেশিরভাগ থানার ওসি-দের বিরুদ্ধে তা অনেক বেশি। রাজনৈতিক প্রভাব থাকায় ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ তাঁদের বিরুদ্ধে যে কোনও শাস্তিমূলক পদক্ষেপ নিতে পারবেন না, তা তাঁদের জানা হয়ে গিয়েছে।

এক পুলিশ কর্তার দাবি, গত পাঁচ-ছয় বছর ধরে রাজ্য ও কলকাতা পুলিশের বদলির তালিকা তৈরি করছেন ‘প্রভাবশালী’-ঘনিষ্ঠ কয়েক জন পুলিশ ইনস্পেক্টর। ওই পুলিশ কর্তার সংযোজন, ‘‘মাস দুয়েক আগে কোনও এক ঘটনায় দক্ষিণবঙ্গের একটি থানার আইসিকে তদন্তের ত্রুটি-বিচ্যুতি নিয়ে ভর্ৎসনা করেছিলেন এক আইজি পদমর্যাদার অফিসার। কয়েক দিন পরে পুলিশের ওই বড় কর্তাকেই কম গুরুত্বপূর্ণ পদে বদলি করে দেওয়া হয়েছে।’’

রাজ্য পুলিশের কর্তাদের একাংশের কথায়, ‘‘ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশ ও পরামর্শের বদলে নিচু তলার পুলিশকর্মীরা স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের পরামর্শ ও নির্দেশকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন। রাজনৈতিক নেতারা নিচুতলার পুলিশদের নিজেদের মতো করে নিয়ন্ত্রণ করছেন। ফলে ভেঙে পড়ছে পুলিশের গঠনতন্ত্র। বাড়ছে দুর্নীতি। কয়লা ও গরু পাচার কাণ্ডে রাজ্য পুলিশের নিচু তলার অফিসার জড়িত রয়েছেন বলে সিবিআই তদন্তে উঠে এসেছে।’’ আবার নিচুতলার পুলিশকর্মীদের একাংশের পাল্টা বক্তব্য, অনেক ক্ষেত্রে ‘প্রভাবশালীদের’ চাপে বড় কর্তারাও অনেক অনৈতিক কাজ করার জন্য তাঁদের নির্দেশ দিয়ে থাকেন। চাকরি বজায় রাখার তাগিদে সেই নির্দেশ পালন করতে হয়। পরে সমস্যা হলে শাস্তির খাঁড়া নেমে আসে নিচুতলার কর্মীদের উপর। পার পেয়ে যান বড় কর্তারা। রাজ্যের প্রাক্তন পুলিশ কর্তা পঙ্কজ দত্ত বলেন, ‘‘রাজ্য পুলিশের বর্তমান পরিকাঠামোয় প্রতিটি পদ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কনস্টেবল থেকে ডিজি, প্রতিটি পদের অসীম গুরুত্ব রয়েছে। প্রতিটি পদাধিকারীর মধ্যে সমন্বয় থাকাটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গঠনতন্ত্র অনুযায়ী আইনি নির্দেশ পালন করতে হবে। অনুশাসন অনুযায়ী তা যদি সঠিক পদ্ধতিগত ভাবে পালন না করা হয়, তা হলে বড় বিপর্যয়ের মুখে পড়তে হবে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন