গত বছরের কথা। তৃণমূলের টিকিটে নিষিদ্ধ সংগঠন সিমি-র অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা রাজ্যসভার সাংসদ হতে যাচ্ছেন দেখে এক গোয়েন্দা অফিসার বলেছিলেন, ‘‘প্রায় সব দলেই চোর, ডাকাত, গুন্ডা, বদমাশ আছে। কিন্তু এই দলে তো দেখি সন্ত্রাসবাদীও ঢুকে পড়ল!’’
সন্ত্রাসবাদী। চর। জঙ্গি। দেশদ্রোহী। রাজ্যের শাসক দল তৃণমূলের সঙ্গে রবিবার আরও এক বার জড়িয়ে গেল শব্দগুলো! যেমন জড়িয়ে গিয়েছিল গত বছর ২ অক্টোবর বর্ধমানের খাগড়াগড়ে বিস্ফোরণের পর। এবং খাগড়াগড়ের মতো এ বারও গোটা ঘটনার সঙ্গে দলের যোগ অস্বীকার করারই প্রাণপণ চেষ্টা চালাচ্ছেন তৃণমূল নেতৃত্ব।
দেশের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে অত্যন্ত সংবেদনশীল গোপন ফৌজি নথি পাকিস্তানে পাচারের অভিযোগে কলকাতা পুলিশের স্পেশ্যাল টাস্ক ফোর্স (এসটিএফ) এ দিন একবালপুর থেকে গ্রেফতার করেছে তিন জনকে। দেশদ্রোহের মামলা রুজু হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। ধৃতদের অন্যতম, ইরশাদ আনসারি তৃণমূলের শ্রমিক সংগঠন আইএনটিটিইউসি-র প্রভাবশালী সদস্য। গ্রেফতার করা হয়েছে ইরশাদের ছেলে আসফাককেও। সে গার্ডেনরিচের হরিমোহন ঘোষ কলেজের তৃণমূল শাসিত ছাত্র সংসদের প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক! সেই হরিমোহন ঘোষ কলেজ, যেখানে ২০১৩-র ফেব্রুয়ারিতে ছাত্র সংসদের নির্বাচনের মনোনয়ন জমা দেওয়াকে ঘিরে দু’পক্ষের সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণ হারান এক পুলিশ অফিসার, গ্রেফতার হন তৃণমূলের বরো চেয়ারম্যান মহম্মদ ইকবাল ওরফে মুন্না। ধৃত তৃতীয় ব্যক্তি ইরশাদের শ্যালক মহম্মদ জাহাঙ্গির।
গার্ডেনরিচ শিপ বিল্ডার্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ার্স-এ একটি ঠিকাদার সংস্থা-নিযুক্ত কর্মী হিসেবে কাজ করত ইরশাদ। এই সংস্থাটিতে যুদ্ধজাহাজ তৈরি হয়। অভিযোগ, সুযোগ বুঝে অফিস থেকে নৌসেনার গুরুত্বপূর্ণ নথি পাচার করত ইরশাদ। গোয়েন্দা সূত্রের খবর, দু’বার বাংলাদেশে গিয়ে বাবার দেওয়া নৌসেনার কিছু গোপন তথ্য-ছবি সেখানকার আইএসআই এজেন্টদের হাতে তুলে দিয়ে এসেছে আসফাক।
শুক্রবার উত্তরপ্রদেশের মেরঠে পুলিশের হাতে ধরা পড়ে সন্দেহভাজন আইএসআই এজেন্ট ও পাক নাগরিক মহম্মদ কালাম ওরফে ইজাজ। গোয়েন্দাদের বক্তব্য, কলকাতায় ধৃত ৩ জন ইজাজের ‘সাব-এজেন্ট’ হিসেবে কাজ করত। ২০১৩-র ফেব্রুয়ারিতে পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ হয়ে কলকাতায় এসেছিল ইজাজ। সেই সময়ে বন্দর এলাকায় তার থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছিল ইরশাদ। সে বার ইজাজের জন্য ভারতীয় পাসপোর্ট, আধার কার্ড, রেশন কার্ড ইত্যাদি তৈরি করে দিয়েছিল জাহাঙ্গির। ইজাজ বছর দেড়েক বন্দর এলাকায় ছিল এবং সেই সময়ে নৌসেনার বহু গোপন তথ্য তার হাতে ইরশাদ তুলে দিয়েছে বলে গোয়েন্দাদের দাবি।
গার্ডেনরিচের রামনগর লেনে একটি তিনতলা বাড়ির দোতলায় সপরিবার ইরশাদের বাস। তিনতলায় থাকেন বাড়ির মালিক। যিনি কলকাতা পুরসভায় তৃণমূলের মেয়র পারিষদ সামসুজ্জামান আনসারির ভাগ্নি। সেখান থেকে মেরেকেটে এক কিলোমিটার দূরেই মেটিয়াবুরুজ এলাকার লোহা গলির মসজিদ তালাও। ২০১২-র ৮ এপ্রিল সেখানেই এক শক্তিশালী বিস্ফোরণে নিহত হয়েছিলেন দু’জন। সেই সময়ে গোয়েন্দাদের একাংশ অভিযোগ করেছিলেন, পুলিশকে প্রথমে ঘটনাস্থলে ঢুকতেই দেওয়া হয়নি। সামসুজ্জামানের লোকজন বিস্ফোরণস্থল ঘিরে রেখেছিল অনেকক্ষণ। তিনি তখনও মেয়র পারিষদ। পুলিশ ও গোয়েন্দারা যখন ঘটনাস্থলে ঢোকেন, ততক্ষণে বহু প্রমাণ লোপাট করে দেওয়া হয়েছে। ক্ষুব্ধ গোয়েন্দাদের বক্তব্য ছিল, ঘটনাটি যাতে নিছক পেটো বোমার বিস্ফোরণ হিসেবে প্রতিপন্ন করা যায়, সেই জন্যই পুলিশকে ঢুকতে না দিয়ে বহু প্রমাণ মুছে ফেলা হয়েছিল। কারণ, ওই ঘটনা মামুলি বিস্ফোরণ ছিল না বলেই তাঁরা অনেকাংশে নিশ্চিত। তবে এ দিন সামসুজ্জামানকে ওই কথা জিজ্ঞেস করায় তিনি বলেন, ‘‘সব মিথ্যে। এ সব হাস্যকর, ভিত্তিহীন অভিযোগ!’’ তবে আসফাক সম্পর্কে সামসুজ্জামানের বক্তব্য, ‘‘যত দূর জানি, ও বন্দর এলাকারই ছেলে।’’
তাৎপর্যপূর্ণ হল, খাগড়াগড়ের তদন্তে নেমে জাতীয় তদন্তকারী সংস্থা (এনআইএ) জানতে পারে, বিস্ফোরণে নিহত বাংলাদেশের নাগরিক শাকিল গাজি দর্জির ভেক ধরে বেশ কিছু দিন মেটিয়াবুরুজেই ছিল। সে থাকত ওই বিস্ফোরণ-স্থলের কাছেই এবং তার থাকার বন্দোবস্ত করেছিল সিমি-র লোকজন। ভারত ও বাংলাদেশের গোয়েন্দা-পুলিশের একাংশের অভিযোগ, সিমি-র অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ওই তৃণমূল সাংসদের মাধ্যমেই সারদার টাকা বাংলাদেশি জঙ্গিদের হাতে পৌঁছত। নেতারা সেই অভিযোগ উড়িয়ে দিলেও খাগড়াগড় কাণ্ডের অস্বস্তি পুরোপুরি ঝেড়ে ফেলতে পারেনি তৃণমূল। কারণ, যে বাড়ির দোতলায় ওই বিস্ফোরণ হয়, তার একতলায় ছিল তৃণমূলের দলীয় কার্যালয়!
একই বাড়িটির দোতলায় জঙ্গি সংগঠন জামাতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ (জেএমবি) ছোটখাটো কারখানা ও গবেষণাগার গড়ে তুলল, মাসের পর মাস সেখান থেকে বিপুল পরিমাণ বিস্ফোরক ও আইইডি (ইম্প্রোভাইজড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস) অবাধে তৈরি ও পাচার হয়ে গেল অথচ তৃণমূলের স্থানীয় নেতা-কর্মীরা কেন তা টের পেলেন না— প্রশ্নটা তখনই উঠেছিল। গোয়েন্দাদের দাবি, পরে তদন্তে এ-ও জানা যায় যে, শাসক দলের কয়েক জন স্থানীয় নেতা এ সবের কিছুটা আঁচ পেয়েছিলেন। কিন্তু তাঁরা চুপ করে থাকেন, কারণ ওই জঙ্গি ডেরায় তৈরি বুলেট ও বোমা ভোটের সময়ে তাঁদের কাছে বিনামূল্যে সরবরাহ করা হবে বলে প্রতিশ্রুতি মিলেছিল।
স্বাভাবিক ভাবেই, এই সমস্ত অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছিল তৃণমূল। নেতারা দাবি করেছিলেন, কেবল লোকসভা ভোটের সময়ে খাগড়াগড়ের ওই বাড়িতে দলীয় কার্যালয় করা হয়েছিল। ভোটের পরে তা বন্ধ করে দেওয়া হয়। দায় ঝেড়ে ফেলার সেই ধারা এ দিনের চর-কাণ্ডের পরেও অব্যাহত। তবে গার্ডেনরিচের ঘটনায় কলকাতা পুলিশেরই এসটিএফ তিন জনকে গ্রেফতার করায় কেন্দ্রীয় সরকার বা গোয়েন্দা সংস্থার বিরুদ্ধে ‘চক্রান্তে’র অভিযোগ এখনও তুলতে পারেননি শাসক দলের নেতৃত্ব।
বন্দর এলাকার বিধায়ক তথা রাজ্যের মন্ত্রী ফিরহাদ (ববি) হাকিমের সঙ্গে এ দিন টেলিফোনে যোগাযোগ করে এই বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, ‘‘আমি এখন সৌদি আরবে। কলকাতায় কী হচ্ছে জানি না, বলতেও পারব না।’’ তৃণমূলের মহাসচিব তথা রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের দাবি, ধৃত আসফাকের সঙ্গে শাসক দলের কোনও সম্পর্ক নেই, তাকে কখনও দলীয় সদস্যপদ দেওয়া হয়নি। তবে সরাসরি দলের সদস্য না হয়ে কেউ যে কোনও ছাত্র সংগঠন করতেই পারেন। পার্থবাবুর কথায়, ‘‘ধৃত ব্যক্তি প্রথমে এলাকায় সিপিএম, পরে কংগ্রেস এবং শেষে তৃণমূল ছাত্র পরিষদে ঢুকেছিল। হরিমোহন ঘোষ কলেজের ছাত্র সংসদের ভোট পেয়ে সে সাধারণ সম্পাদক হয়েছিল। কিন্তু এলাকা থেকে মাস্তানির নানা অভিযোগ আসতে থাকায় আপত্তির মুখে সে ওই পদ ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়।’’ মহাসচিবের বক্তব্য, ওই ছাত্র নেতাকে কখনওই তৃণমূলের তরফে কোনও দায়িত্ব দেওয়া হয়নি। অবশ্য একই সঙ্গে তিনি বলেছেন, ‘‘আইন আইনের পথে চলবে।’’
টিএমসিপি-র রাজ্য সভাপতি অশোক রুদ্র বলেন, ‘‘সাংগঠনিক কারণে দু’মাস আগেই আসফাককে কলেজের ছাত্র সংসদের ওই পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। সংগঠন থেকে বহিষ্কারও করা হয়েছে।’’ ১৩৩ নম্বর ওয়ার্ডের তৃণমূল কাউন্সিলর তথা ১৫ নম্বর বরোর চেয়ারম্যান রঞ্জিত শীলের বক্তব্য, ‘‘আসফাক আনসারিকে চিনতাম। শুনেছিলাম, মাস তিনেক আগে সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে ওকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। তবে ওর ব্যাপারে বিশেষ কিছু জানি না।’’ আর হরিমোহন ঘোষ কলেজের সেই ঘটনায় অভিযুক্ত মুন্নার বক্তব্য, ‘‘ওই এলাকায় ছাত্র রাজনীতির ব্যাপারে আমি কিছু জানি না।’’
উল্টো দিকে আসফাকের বোন সাইরিন বলছেন, ‘‘আমার ভাই হরিমোহন ঘোষ কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্র এবং সে তৃণমূলের সক্রিয় ছেলে।’’ ইরশাদকে নিয়ে অবশ্য কোনও মন্তব্য করেননি শাসক দলের নেতারা।
এমন হাতিয়ার পেয়ে প্রত্যাশিত ভাবেই তৃণমূলকে রেয়াত করতে নারাজ বিরোধীরা। সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য রবীন দেবের যেমন অভিযোগ, ‘‘যা কিছু অশুভ, সে সবের সঙ্গেই তৃণমূলের যোগাযোগ বারবার স্পষ্ট! এমনকী, দেশদ্রোহী শক্তির সঙ্গে তৃণমূলের যোগাযোগের অভিযোগ ওদের এক জন সাংসদ নির্বাচন এবং খাগড়াগড় থেকেই চলে আসছে!’’ এসএফআই নেতা শতরূপ ঘোষের কটাক্ষ, ‘‘তৃণমূল রাজ্যে সন্ত্রাস তৈরি করায় এমন পারদর্শিতা দেখিয়েছে যে, আইএসআই পর্যন্ত ছাত্র সেজে তাদের কাছে শিখতে এসেছে!’’ কংগ্রেস বিধায়ক মানস ভুঁইয়ার প্রশ্ন, ‘‘ক’দিন আগেই পশ্চিম মেদিনীপুরে জাল নোট-চক্রের সঙ্গে শাসক দলের যোগ সামনে এসেছে। এই দলটা ক্রমশ জাতীয়তা-বিরোধী কার্যকলাপে জড়িয়ে যাচ্ছে।’’
খাগড়াগড়-কাণ্ড নিয়ে প্রবল ভাবে সরব হয়েছিল বিজেপি। এ বারও তাদের রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ বলছেন, ‘‘এ রাজ্যে আইএস বা জামাতের লোকজন সবই তৃণমূলে রয়েছে। ভাল করে তদন্ত হলে দেখা যাবে, আসফাক একটা নমুনা মাত্র। তৃণমূলের ভূরি ভূরি বড় নেতাই বিদেশি জঙ্গিদের সঙ্গে যুক্ত!’’ শিলিগুড়িতে এ দিনই বিজেপি-র কেন্দ্রীয় মুখপাত্র শাহনওয়াজ হুসেন বলেছেন, সন্দেহভাজন জঙ্গিদের আস্তানা হয়ে উঠছে পশ্চিমবঙ্গ। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই ধরনের কার্যকলাপ কড়া হাতে মোকাবিলা করতে চাইলে এখনও কেন্দ্রীয় সরকার সাহায্য করতে তৈরি।
গোয়েন্দাদের একাংশের দাবি, আইএনটিটিইউসি-র প্রভাবশালী সদস্য হওয়ার সুবাদে স্থানীয়
কয়েক জন পুলিশ অফিসারের সঙ্গে দহরম-মহরম ছিল ইরশাদের। কিন্তু জাহাজ তৈরির সংস্থার এমন স্পর্শকাতর এলাকায় কাজ দেওয়ার আগে তার সম্পর্কে ভাল করে খোঁজখবর নেওয়া হয়েছিল কি না, সেই প্রশ্ন উঠেছে। অনেকের মতে, শাসক দলের সদস্য হওয়ার সুবাদেই ঠিকাদারের মাধ্যমে ওই সংস্থায় কাজ পেতে সমস্যা হয়নি তার। আবার ইরশাদের ছেলেকে নিয়ে শাসক দলের নেতারা দায় এড়ালেও ফের প্রশ্ন ওঠে, দলে কোনও ছাঁকনির ব্যবস্থা নেই কেন? যে কেউ যে কোনও জায়গা থেকে এসে তৃণমূলের সংগঠনে ঢুকে পড়তে পারেন, এটাই বা কেমন কথা? এর কোনও সদুত্তর মেলেনি তৃণমূল নেতৃত্বের কাছ থেকে!