Bratya Basu and CV Anand Bose

নবান্ন ও আনন্দের মাঝে সেতু হলেন মন্ত্রী ব্রাত্য, তবে রাজভবন-তৃণমূল দূরত্ব এখনও রয়েই গেল

রাজ্যপাল আনন্দের নিন্দায় সরব তৃণমূলের একাধিক নেতা। দলের মুখপত্রেও কড়া সমালোচনা করা হয়েছে। তবে অনেক ক্ষেত্রে উল্টো সুর শোনা গেল শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসুর গলায়। এই স্বর কি তবে নবান্নের!

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ১৭:২৫
Share:

ব্রাত্য কি পারলেন? ফাইল চিত্র।

রাজভবন ও নবান্নের মধ্যে টানা টানাপড়েনের মধ্যেই রাজ্যপালের সঙ্গে বৈঠক করলেন শিক্ষামন্ত্রী। ঘণ্টা দুয়েকের বৈঠক শেষে মঙ্গলবার রাজভবনের চত্বরেই যৌথ সাংবাদিক বৈঠক করলেন সিভি আনন্দ বোস এবং ব্রাত্য বসু। স্বতঃপ্রণোদিত ভাবে বা সংবাদমাধ্যমের প্রশ্নের উত্তরে বার বার সংঘাতকে ‘অতীত’ করে এ বার নবান্ন-রাজভবন মিলেমিশে চলবে বলেই দাবি করলেন ব্রাত্য। পাশাপাশি দলের অন্য নেতাদের মুখে বা দলীয় মুখপত্রে আনন্দের সমালোচনা নিয়ে প্রত্যাশিত ভাবে দলের হয়েই সাফাই দিলেন শিক্ষামন্ত্রী।

Advertisement

তবে ব্রাত্যের নবান্ন-রাজভবন এক হয়ে কাজ করার দাবির সঙ্গে তৃণমূলের দলগত অবস্থানের ফারাক রয়েছে। দল হিসাবে তৃণমূল রাজ্যপালকে আক্রমণের পথ নিয়েছে। আর ব্রাত্য বলেছেন নবান্ন তথা সরকারের তরফে সহযোগিতার কথা। তা হলে কি রাজ্যপাল প্রসঙ্গে নবান্ন ও তৃণমূলের বক্তব্য যে আলাদা, সেটাই স্পষ্ট করে দিলেন ব্রাত্য?

বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগ সমস্যা মেটাতে সোমবার রাজ্যপাল তথা সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলির আচার্য রাজ্যপালের সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন শিক্ষামন্ত্রী। তার পরে মঙ্গলবারেও তাঁদের বৈঠক হয়। বিশ্ববিদ্যালয়গুলির উপাচার্য নিয়োগ সংক্রান্ত জটিলতা কাটানোই বৈঠকের মূল লক্ষ্য হলেও এ-ও ঠিক যে, চলতি সংঘাতের মধ্যে সরকারের কোনও প্রতিনিধি হিসাবে প্রথম ব্রাত্যই রাজভবনে গিয়েছিলেন। তাঁর বক্তব্যে এটা স্পষ্ট যে, তিনি রাজভবনের সঙ্গে কোনও রকম ‘বিতর্ক’ চাইছেন না। মঙ্গলবারের সাংবাদিক বৈঠকে ব্রাত্য যেমন রাজ্যপালের সঙ্গে আলোচনার বিষয় তুলে ধরেছেন, তেমনই সব সমস্যার সমাধানেই মুখ্য ভূমিকা যে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের, সে কথাও উল্লেখ করেছেন। আবার ব্রাত্যের পাশে বসে ‘কেন্দ্রের প্রতিনিধি’ আনন্দও তাঁর কথায় নিয়ে এসেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর শিক্ষা নিয়ে ভাবনার কথা। মোদীর ‘আত্মনির্ভর ভারত’ স্লোগানের কথা।

Advertisement

দু’জনের কথায় কিছু কিছু ফারাক থেকে গেলেও নবান্ন যে রাজভবনের সঙ্গে ‘তালমিল’ রেখেই চলতে চাইছে, তা বুঝিয়ে দিয়েছেন ব্রাত্য। অনেক সময়েই রাজ্যপালকে করা প্রশ্নের উত্তর সংবাদমাধ্যমকে তিনিই উপযাচক হয়ে দিয়ে দিয়েছেন। বস্তুত, শুরুতেই ব্রাত্য বলেছেন, ‘‘মাস দেড়েক আগেই আমি এবং রাজ্যপাল বার্তা দিয়েছিলাম, রাজভবনের সঙ্গে নবান্নের আগে (জগদীপ ধনখড়ের আমলে) যা হয়েছে, তা অতীত। এখন রাজভবনের সঙ্গে নবান্ন মিলিত ভাবেই কাজ করবে। যতই জল্পনা থাক, যতই উস্কে দেওয়া থাক, আমরা আমাদের সেই বক্তব্য পুনরাবৃত্তি করছি।’’

তবে গত কয়েক সপ্তাহে ঘটনাপ্রবাহ যে ভাবে চলেছে, তাতে ব্রাত্যের কথায় ধনখড়ের আমল যেমন ‘অতীত’, তেমনই অতীত তাঁর ‘সাম্প্রতিক অতীত’-এর বক্তব্যও। সম্প্রতি রাজ্যপালের প্রধান সচিব নন্দিনী চক্রবর্তীকে সরিয়ে দেওয়া নিয়ে রাজ্যের পর পর দু’টি বিবৃতি অন্য আবহ তৈরি করেছে। তা নিয়ে একের পর এক তৃণমূল নেতা এবং বিধায়ক বিরূপ মন্তব্য করেছেন রাজ্যপাল বোস সম্পর্কে। কখনও তাঁর বাংলা শিক্ষার আগ্রহ নিয়ে খোঁচা দেওয়া হয়েছে, কখনও তাঁর ‘রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা’ নিয়ে আক্রমণ করা হয়েছে। রাজ্যপাল চাকরি বাঁচাতে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী নিশীথ প্রামাণিকের গাড়িতে হামলার ঘটনার নিন্দা করেছেন বলেও দাবি করা হয়েছে তৃণমূলের পক্ষে। দলের মুখপত্রেও রাজ্যপালকে ‘বিজেপির ক্যাডার’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, রাজ্যপাল বোস তাঁর পূর্বসূরি ধনখড়ের পথ দ্রুত অনুসরণ করার প্রতিযোগিতায় নেমে পড়েছেন।

এই সংক্রান্ত প্রশ্ন উঠলে শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য রাজ্যপাল আনন্দের পাশে বসে নিজের দলের পাশেই দাঁড়িয়েছেন। দলের নেতা বা মুখপত্রের সমালোচনা না করে বলেছেন, ‘‘আমাদের দল অনেক ফ্লেক্সিব্‌ল (নমনীয়)। আমাদের দল তো কোনও রেজিমেন্টেড পার্টি নয়। অনেকের অনেক রকম মত থাকতে পারে। অনেক মিডিয়া উস্কেও দিতে পারে— যদি (রাজ্যপালের সঙ্গে) একটু দূরত্ব থাকে তা হলে মন্দ কি? একটু খোরাক পাওয়া যায়। আর কি?’’ একই সঙ্গে ব্রাত্য বলেন, ‘‘আমি বলছি অতীতের পুনরাবৃত্তি হবে না। সম্ভাবনা নেই। রাজ্যপাল রাজ্য ও সংবাধিনিক প্রধান। আর স্যর জানেন ইলেক্টেড হেড অফ দ্য স্টেট হলেন মুখ্যমন্ত্রী।’’

তবে ‘রাজনীতিক’ ব্রাত্য দলকে আড়াল করার পাশাপাশি ‘মন্ত্রী’ হিসাবে অন্য কথাও বলেছেন। তাঁর কথায়, ‘‘রাজ্যপাল কোনও রাজনৈতিক দলের নন। তিনি সবার। যদি এই সংক্রান্ত কোনও পর্ব থেকে থাকে, তা হলে তা অতীত। এখন থেকে রাজভবন ও নবান্ন সমন্বয় রেখে কাজ করবে।’’

নিশীথের উপরে হামলার ঘটনা নিয়ে রবিবার রাতের বিবৃতিতে রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন রাজ্যপাল। আইনের শাসন চেয়ে বলেছেন, রাজ্যপাল ‘নির্বাক দর্শক’ হয়ে থাকবেন না। দিনহাটার ঘটনায় রাজ্য প্রশাসন কী কী ব্যবস্থা নিয়েছে, সেই রিপোর্টও নবান্নের কাছ থেকে তলব করেছেন আনন্দ। সে বিষয়ে রাজ্যের এক প্রাক্তন মন্ত্রী তথা তৃণমূল বিধায়ক বলেছেন, ‘‘রাজ্যপাল ভেবেছিলেন আস্তে আস্তে সিঁদ কাটবেন। ধরা পড়বেন ভাবতে পারেননি। বাংলার রাজনীতিতে লড়তে গেলে বাংলাকে চিনতে হবে। কেউই আমাদের রাজ্যপাল নয়, সবাই বিজেপির রাজ্যপাল।’’

সেই প্রসঙ্গে প্রশ্ন ওঠায় ব্রাত্য বলেন, ‘‘ধরে নেওয়া যাক, হিংসা নিয়ে যে কথাটা উঠেছে এটা সাম্প্রদায়িক উস্কানি নিয়েও হতে পারে। এমনও হতে পারে, ওটা সাম্প্রদায়িক উস্কানি নিয়ে স্যর বলেছেন। আমরা ব্যাপারটা উল্টো ভাবে না দেখে পজ়িটিভলিও দেখতে পারি। কোন বিধায়ক কী মন্তব্য করেছেন আমি জানি না। কিন্তু এ সব নিয়ে জলঘোলা করার কোনও মানে নেই।’’

রাজ্যপালের কাছে রাজ্যের বর্তমান আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে মতামত জানতে চাইলে খানিকটা উদ্যোগী এবং সক্রিয় হয়েই সংবাধমাধ্যমকে চুপ করান ব্রাত্য। প্রশ্ন ছিল, রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে রাজ্যপাল কী ভাবছেন? রাজ্যপাল মুখ খোলার আগেই ব্রাত্য বলে দেন, ‘‘আমি মনে করি এই প্রশ্নের জন্য এটা সঠিক জায়গা নয়।’’ নবান্নের সঙ্গে রাজভবনের কেমন সম্পর্ক রেখে চলা উচিত? এই প্রশ্নে রাজ্যপাল ইংরেজিতে জবাব দেন, ‘‘গঠনমূলক সহযোগিতা।’’ আনন্দ বলার পরে ব্রাত্যও খানিক উচ্চস্বরে একই কথা বলেন।

ধনখড়ের সময়ে বিভিন্ন বিল আটকে থাকা নিয়ে রাজ্যপালকে প্রশ্ন করা হলে তিনি শুধুই ‘ধন্যবাদ’ জানান। তাঁর পাশ থেকে ব্রাত্য বলেন, ‘‘আমি মনে করি, আগের জমানায় কী হয়েছে, তা নিয়ে প্রশ্নের উত্তর দিতে স্যর বাধ্য নন।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন