ক্যাম্পাসে নেশা, শিবপুর থেকেও শিক্ষা নিতে পারল না যাদবপুর!

আইআইইএসটি পারে, কিন্তু পারে না যাদবপুর! গত সেপ্টেম্বরে মদের বোতল নিয়ে ক্যাম্পাসে ঢোকার সময়ে হাতেনাতে ধরা পড়ায় শাস্তির খাড়া নেমে এসেছিল শিবপুরের ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ ইঞ্জিনিয়ারিং সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি (আইআইইএসটি)-র তৃতীয় বর্ষের দশ ছাত্রের ওপরে। কিন্তু যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের এমনটি যেন ভাবাই যায় না।

Advertisement

সুপ্রিয় তরফদার

শেষ আপডেট: ০৮ ডিসেম্বর ২০১৫ ১৫:৪৭
Share:

আইআইইএসটি পারে, কিন্তু পারে না যাদবপুর!

Advertisement

গত সেপ্টেম্বরে মদের বোতল নিয়ে ক্যাম্পাসে ঢোকার সময়ে হাতেনাতে ধরা পড়ায় শাস্তির খাড়া নেমে এসেছিল শিবপুরের ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ ইঞ্জিনিয়ারিং সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি (আইআইইএসটি)-র তৃতীয় বর্ষের দশ ছাত্রের ওপরে। এক বছরের জন্যে সেমেস্টার থেকে বহিষ্কার, জরিমানা, হস্টেল থেকে বহিষ্কার সহ একাধিক শাস্তির মুখে পড়তে হয়েছে ওই পড়ুয়াদের। কিন্তু যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের এমনটি যেন ভাবাই যায় না। বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্দরেরই অভিযোগ, সন্ধ্যে নামলেই ক্যাম্পাসের ভিতরের মাঠে পড়ুয়াদের একাংশ প্রকাশ্যে মদের আসর বসায়! গোটা মাঠেই ছড়িয়ে পড়ে থাকে মদের বোতলও (আনন্দবাজারের হাতে ভিডিও রেকর্ডিং রয়েছে)। ভারতের প্রথম সারির এমন একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে এ হেন ঘটনায় খুশি নন পড়ুয়াদেরই একটি বড় অংশ। উল্টে তাঁদের ক্ষোভ, এ ক্ষেত্রে পদক্ষেপ নেওয়া তো দূরের কথা, কর্তৃপক্ষ কার্যত থাকেন নিরুত্তাপই।

কিন্তু কেন?

Advertisement

বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্দরে কান পাতলেই শোনা যায়, এর পিছনেও জড়িয়ে রয়েছে ভয়ের পরিবেশ। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিশ্ববিদ্যালয়েরই প্রশাসনিক পর্যায়ের এক কর্তা বলেন, ‘‘ভালোই তো চলছে। কয়েকজন পড়ুয়ার ওই সমস্ত কাজে বাধা দিয়ে শুধু শুধু আন্দোলন ডেকে এনে বিপদ বাডা়নোর কোনও মানেই হয় না।’’ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য অভিজিৎ চক্রবর্তীকে যে ভাবে পড়ুযাদের আন্দোলনের মুখে পড়ে সরে যেতে হয়েছিল, সে কারণে পড়ুয়াদের ‘যে কোনও আন্দোলন’ থেকে নিজেদের দূরে রাখতেই পছন্দ করেন কর্তৃপক্ষ। তাই দেখেও না দেখার পথই শ্রেয় বলে মনে করেন তাঁরা।

আইআইইএসটি-র ক্ষেত্রে যে পরিবেশ নেই বলেই দাবি করেন ডিরেক্টর অজয় রায়। তিনি বলেন, ‘‘এই দায়িত্বে আসার পর থেকেই ক্যাম্পাসের ভিতরে কোনও রাজনীতি করতে দিইনি। ভয়ের আবহ তৈরি হতে দিইনি কারও মধ্যেই। ক্যাম্পাসের ভিতরে পুলিশ ঢোকারও বিরোধিতা করে পরিস্থিতি আয়ত্তে এনেছি।’’ পাশাপাশি তাঁর মন্তব্য, ‘‘ক্যাম্পাসের ভিতরের পরিস্থিতি ঠিক রাখতে গেলে প্রশাসকের থেকে এক জন ভালো শিক্ষক হওয়া প্রয়োজন। তার পাশাপাশি পড়ুয়াদেরও সংযমের প্রয়োজন। আইআইইএসটি-র ক্ষেত্রে তার দুটোই রয়েছে।’’

কিন্তু যাদবপুরের ক্ষেত্রে কেন এই রকম কিছু হয় না?

বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মসমিতির এক সদস্য জানান, ক্যাম্পাসের ভিতরের শিক্ষার পরিবেশ ঠিক রাখার ক্ষেত্রে সাহসী পদক্ষেপ নিয়েছিলেন প্রাক্তন উপাচার্য অভিজিৎ চক্রবর্তী। তিনি জানান, ২০১৪ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর, যে দিন পড়ুয়ারা উপাচার্য সহ একাধিক শিক্ষক-অশিক্ষক কর্মচারীদের ঘেরাও করে রেখেছিলেন, সে দিনের কর্মসমিতির বৈঠকেই ক্যাম্পাসের ভিতরে মদ, মাদক সহ যে কোনও ধরনের নেশা করা ও পরিবেশ নষ্ট করে এমন কিছু কার্যকলাপের ক্ষেত্রেই রাশ টেনে ধরতে চেয়েছিলেন। যে কারণে বেশ কয়েকটি পদক্ষেপ করেছিলেন অভিজিৎবাবু। শক্ত হাতে তার মোকাবিলার জন্যে পড়ুয়া, শিক্ষক, অশিক্ষক কর্মচারীদের নিয়ে একটি কমিটি গঠন করার পথে হেঁটেছিলেন তিনি। এর পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিতরের পরিবেশে কিছুটা রাশ টানা গেলেও তা ফলপ্রসু হয়নি বেশি দিন। কারণ ঘটনাক্রমে ঠিক এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরে ওই দিন রাতেই যৌন নিগ্রহের (পরে যে অভিযোগের সত্যতা পুরোপুরি প্রমাণিত হয়নি) দ্রুত তদন্তের দাবিতে ঘেরাও করে রাখে একদল পড়ুয়া। তার পরে গভীর রাতে ঘেরাও-মুক্ত হওয়ার জন্যে পুলিশ ডাকতে বাধ্য হন উপাচার্য। এর পরে পুলিশের বিরুদ্ধে লাঠিচার্জের অভিযোগ ঘিরে উত্তপ্ত হয় ক্যাম্পাস। শুরু হয় ‘হোক কলরব’ আন্দোলন। পরে ২০১৫-র জানুয়ারিতে পদত্যাগ করেন অভিজিৎবাবু।

কিন্তু তার পর থেকে কর্ম সমিতির বৈঠকের সেই সিদ্ধান্ত রয়ে গিয়েছে খাতায়-কলমেই। প্রায় এক বছর হতে চললেও সেই বিষয় নিয়ে কোনও পদক্ষেপ করেননি কর্তৃপক্ষ। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির আবেদনপত্রেই স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে- মদ, মাদক বা নেশাজাত সমস্ত জিনিস বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসের ভিতরে নিষিদ্ধ। বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্দরে বিভিন্ন জায়গায় ধূমপান নিষিদ্ধ হলেও সেই আইনকে থোড়াই কেয়ার করে পড়ুয়াদের একাংশ। শিক্ষক ও পড়ুয়াদের প্রশ্ন, যদি বাস্তবে তা না মানা হয়, তা হলে আবেদনপত্রে তা রেখে লাভ কী? গত বছরেই কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে মাদকাসক্ত হয়ে মৃত্যু হয়েছে দুই পড়ুয়ার।

বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষক বলেন, ‘‘যাদবপুরের পড়ুয়াদের পড়াশুনার দক্ষতা ও যোগ্যতা নিয়ে কোনও প্রশ্ন নেই। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়টি তো তাঁদেরই। পরিবেশ ভালো রাখার দায়িত্ব তাঁদের তো নিতেই হবে।’’

ছাত্র সংগঠন ফেটসু-র সাধারণ সম্পাদক স্বর্ণেন্দু বর্মন বলেন, ‘‘আমরা সাংগঠনিক ভাবে উদ্যোগ নিয়ে সব সময়ই সেই সব পড়ুয়া বা আমাদেরই সহপাঠীদের কাছে আবেদন করে থাকি ক্যাম্পাসকে যেন নেশার স্থান হিসাবে পরিণত না করা হয়। সেই প্রচেষ্টা চলছে।’’

বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য আনন্দদেব মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘আইআইইএসটি যে পদক্ষেপ করেছে, সেই পদক্ষেপ সকলেরই করা উচিত। কড়া পদক্ষেপের অভাবেই ক্যাম্পাসের ভিতরে এই ধরনের অরাজকতা বাড়ছে। কর্তৃপক্ষের উচিত দ্রুত কড়া পদক্ষেপ করা।’’ তিনি এ-ও জানান, ত্রিগুণা সেন উপাচার্য থাকার সময়ে হস্টেলের ভিতরে মদ খাওয়ার অপরাধে চার পড়ুয়াকে বহিষ্কার করেছিলেন। এখন পরিস্থিতি বদলাতে আগুপিছু না ভেবে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া উচিত, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব।

যাদবপুরের আর এক প্রাক্তন উপাচার্য অশোকনাথ বসু বলেন, ‘‘পরিস্থিতি বদলাতে হলে পড়ুয়াদের নিজেদের, অভিভাবকদের এবং প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষের সঠিক পথে চলা প্রয়োজন।’’ তিনি বলেন, ‘‘পরীক্ষায় পাশ করে শুধু চাকরি পাওয়ার মধ্যেই সার্থকতা নেই। সামাজিক বিষয় নিয়েও পড়ুয়াদের ভাবতে হবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রকাশ্যে ওই সব কার্যকলাপ মোটেই মেনে নেওয়া যায় না। এর জন্য অভিভাবক ও কর্তৃপক্ষেরও দ্রুত পদক্ষেপ করা উচিত।’’

তা হলে প্রশ্ন উঠেছে কেনই-বা কর্তৃপক্ষ কোনও পদক্ষেপ করছেন না? বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিতরের পরিস্থিতি ফেরানোর দায় কি কর্তৃপক্ষের নয়?

উপাচার্য সুরঞ্জন দাস বলেন, ‘‘এই বিষয়ে অভিযোগ পেয়েছি। বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন