সাংবাদিকদের মুখোমুখি কানহাইয়া (মাঝখানে)। সঙ্গে ছাত্র সংসদের সহ-সভাপতি সেহলা রসিদ (বাঁ দিকে) এবং রাম নাগা। ছবি: পিটিআই।
তাঁকে চিনত জেএনইউ ক্যাম্পাস। বিহার ভোটে তাঁকে কিছুটা চিনেছিল বেগুসরাই। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের ভোটে যে কানহাইয়া কুমার প্রচারে আসবেন, তিনি আগের সেই কানহাইয়া নন। তিনি জাতীর রাজনীতির নতুন তারকা।
তিহাড় জেল থেকে জামিনে ছাড়া পাওয়া কানহাইয়া, জেএনইউ ক্যাম্পাসে বক্তৃতা করে গোটা দেশকে মাতিয়ে তোলা কানহাইয়ার নাম এখন সকলের মুখে মুখে। সংবাদমাধ্যমে সোশ্যাল মিডিয়ায় তাঁর বক্তৃতা ভাইরাল হয়ে ঘুরছে। উত্তেজনার এই প্রবল আঁচেই ঘোষণা হয়ে গেল পশ্চিমবঙ্গের ভোট নির্ঘণ্ট। কানহাইয়াও প্রথম দিকে খানিকটা ইতস্তত করেও রাতে এবিপি নিউজকে জানিয়ে দিলেন, ‘‘জেএনইউ ছাত্র কাউন্সিল বললে আমি বিধানসভা নির্বাচনের প্রচার করতে পশ্চিমবঙ্গ যাব। কাউন্সিল যা বলবে তাই হবে। বললে পঞ্জাবেও যাব।’’
অর্থাৎ সক্রিয় রাজনীতিতে নামার জন্য কানহাইয়া এক প্রকার তৈরি। অথচ ক’দিন আগে পর্যন্তও কানহাইয়া মানে ছিল শ্যামলা, মাঝারি উচ্চতার একটি ছেলে। জেএনইউ ছাত্র সংসদের জনপ্রিয় নেতা। সুবক্তা। হাসিমুখে যুক্তির সঙ্গে তর্ক মিশিয়ে প্রখর উপস্থাপনার ক্ষমতাই তাঁকে ছাত্রনেতা বানিয়েছিল। গত বছর বিহারের নির্বাচনী ময়দানে পৈতৃক জেলায় বক্তৃতা করে সাড়া ফেলেছিলেন বছর সাতাশের কানহাইয়া। এক সময় বিহারের লেনিনগ্রাদ বলে পরিচিত বেগুসরাইয়ে সিপিআইকে জেতাতে না পারলেও বক্তা হিসেবে নিজের জাত চিনিয়েছিলেন!
খাতায়কলমে সূত্রপাত তখনই। কিন্তু তার পরিধিই বা কতটুকু ছিল? মোদী সরকার দেশদ্রোহের মামলা ঠুকে কার্যত কানহাইয়াকে রাতারাতি দেশনেতার আসন দিয়েছে। গত কাল জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পরে যে ভাবে কানহাইয়া প্রধানমন্ত্রী থেকে বিজেপি-সঙ্ঘ পরিবারকে হাসতে হাসতে একহাত নিয়েছেন, কথার পিঠে কথা জুড়ে আক্রমণ শানিয়েছেন, তা দেখে রীতিমতো অবাক ঝানু রাজনীতিকরা। ডান-বাম তো বটেই! বিজেপি সাংসদেরাও মেনে নিচ্ছেন, ‘‘নাঃ, ছেলেটা বলে ভাল।’’ কানহাইয়ার মুখে আজাদির ডাক এক দিনে দেশবাসীর স্লোগান হয়ে দাঁড়িয়েছে। দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরীবাল, আমজনতার নেতা হয়ে উঠে আসা কেজরীবালকে এখন কানহাইয়ার স্লোগান ধার করে আজাদির টুইট করতে হচ্ছে!
এ যেন স্বপ্নের উত্তরণ। কানহাইয়া নিজেও হয়তো এতটা ভাবেননি। প্রকাশ কারাট, সীতারাম ইয়েচুরি বা ডি পি ত্রিপাঠীর পর ফের এক সর্বভারতীয় ছাত্রনেতার জন্ম দেখছে জেএনইউয়ের পাথুরে মাটি। চড়চড় করে বাড়ছে প্রত্যাশা। ঘটনাচক্রে আজই পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচনের দিনক্ষণ ঘোষাণা হয়েছে। সেই সূত্র ধরেই সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি জানিয়ে দেন, পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচনে প্রচারে যাবেন কানহাইয়া। সেটা শুনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতিক্রিয়া, ‘‘যে কেউ আসতে পারেন। গণতান্ত্রিক রাজ্য!’’ তবে জোট আবহে কানহাইয়া যে বাড়তি উদ্দীপনা তৈরি করতে পারেন, সেটা সম্ভবত তৃণমূলও অস্বীকার করবে না। তাঁরা তো মনেই করছেন, মোদীই ডেকে আনলেন তারকার জন্ম!
জেল থেকে বেরনোর পরে আজ প্রথম সাংবাদিক সম্মেলন ছিল কানহাইয়ারও। পরনে ঘিয়ে রঙের হাফ শার্ট, গোটানো জিন্স, পায়ে রবারের চটি। বঙ্গ সফরের সম্ভাবনা আছে কি না, সেই প্রশ্ন শুনে কিছুটা ইতস্তত। বললেন, ‘‘বঙ্গাল অভি দূর হ্যায়। তার আগে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক সমস্যা মেটাতে হবে আমায়। কারণ সবার আগে আমি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের নেতা। পড়ুয়ারা আমার ভরসা করে ভোট দিয়েছে।’’ রাতে এবিপি নিউজের সাক্ষাৎকারে যখন এলেন, তখন অবশ্য কুণ্ঠা অনেকটা কেটেছে। পশ্চিমবঙ্গে যাওয়ার কথা তখন নিজের মুখেই বললেন তিনি।
সংশয় ছিল মনে? ছাত্র সংসদের প্রতিনিধিরা বলছিলেন পরে, হাইকোর্ট জামিন দেওয়ার সময়ে কানহাইয়াকে এক গাদা শর্ত দিয়েছে। সেই সব ভেবেই প্রথমে ইতস্তত করছিলেন কানহাইয়া। কিন্তু রাজ্যে রাজ্যে নির্বাচনী প্রচারে যাওয়ার রেওয়াজ জেএনইউ পড়ুয়াদের মধ্যে দীর্ঘদিনই রয়েছে। গত বিধানসভা নির্বাচনেও নন্দীগ্রাম-সিঙ্গুরের ঘটনার প্রতিবাদ জানাতে বহু ছাত্র ভিড় জমিয়েছিলেন রাজ্যের মাটিতে। আবার বামেদের সমর্থনে প্রচারে সাহায্য করতে পৌঁছে গিয়েছিলেন এসএফআইয়ের সদস্যেরা। সেই ইতিহাস মেনেই ইয়েচুরিরা চাইছেন কানহাইয়াকে পশ্চিমবঙ্গে নিয়ে যেতে।
সব ঠিক থাকলে কানহাইয়া পশ্চিমবঙ্গে আসবেনও। তবে সামগ্রিক ভাবে কিন্তু প্রত্যক্ষ রাজনীতির চেয়ে তিনি আপাতত জোর দিতে চাইছেন বিশ্ববিদ্যালয়েই। নিজের পরবর্তী পদক্ষেপের ব্যাখ্যায় কানহাইয়া বলে চলেন, ‘‘সরাসরি রাজনীতি এখনই নয়। যদি কোনও ছাত্রের ফেলোশিপ বন্ধ হয়ে যায়, লড়াইতে নামতে পারি। যদি কোনও ছাত্র রোহিতের মতো অবিচারের শিকার হয়, তা হলে লড়াই করতে পারি। রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে বিনা কারণে কাউকে জেলে ঢোকালেও লড়াইতে নামতে পারি।’’ প্রশ্নোত্তরে উঠে আসে আফজল গুরু প্রসঙ্গ। কানহাইয়া বলেন, ‘‘আফজল নন। আমার আইকন রোহিত ভেমুলা।’’
রোহিত ও কানহাইয়া দু’জনেই দরিদ্র পরিবারের সন্তান। রাষ্ট্রের পীড়ন সহ্য করতে না পেরে রোহিত আত্মঘাতী। কানহাইয়া কিন্তু ফিরে এসেছেন নতুন আশা দেখিয়ে। তাঁকে ঘিরে ঘুরে দাঁড়াতে চাইছে জেএনইউ-সহ, কানহাইয়ার নিজের দলও। কার্যত ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া সিপিআই।