একই গ্রামে একাধিক রহস্য-মৃত্যুর ঘটনায় রঘুনাথগঞ্জ থানা কী তদন্ত করেছে, মুর্শিদাবাদ জেলার পুলিশ সুপারকে তার রিপোর্ট দাখিল করতে নির্দেশ দিল কলকাতা হাইকোর্ট। বুধবার হাইকোর্টের বিচারপতি দীপঙ্কর দত্ত রাজ্যের জিপি-কে (গভর্নমেন্ট প্লিডার) ওই রিপোর্ট আগামী ৮ সেপ্টেম্বরের মধ্যে আদালতে পেশ করতে বলেছেন।
পুলিশ জানায়, রঘুনাথগঞ্জ থানা এলাকার লালখাঁদিয়ার গ্রামটি বাংলাদেশের সীমান্ত লাগোয়া। ওই গ্রামের বিভিন্ন এলাকা থেকে গত চার বছরে বিভিন্ন সময়ে এক মহিলা-সহ পাঁচ জনের দেহ উদ্ধার করা হয়। পাঁচ জনেই প্রথমে নিখোঁজ ছিলেন। তাঁদের পরিবারের লোকজন থানায় প্রথমে নিখোঁজের ডায়েরি করেন। পরে তাঁদের দেহ উদ্ধার হয়। পুলিশের দাবি, ময়না-তদন্তের প্রাথমিক রিপোর্ট অনুযায়ী সকলের দেহেই আঘাতের চিহ্ন ছিল। মৃতদের পরিবারের অভিযোগ, তাঁদের পরিজনদের খুন করা হয়েছে।
পুলিশ জানায়, মৃতদের মধ্যে রয়েছেন সঞ্জয় মণ্ডল (৪২) নামে এক যুবক। ওই যুবক চলতি বছরের ৪ মার্চ নিখোঁজ হন। পরের দিন গ্রামের একটি জায়গা থেকে তাঁর দেহ উদ্ধার হয়। সঞ্জয়ের দাদা সহদেবের অভিযোগ, থানার পুলিশ তাঁর ভাইয়ের মৃত্যুকে ‘অস্বাভাবিক’ বলে কেবল চিহ্নিত করে প্রথমে একটি ডায়েরি করে। সহদেবের অভিযোগ, তাঁর ভাইকে খুন করা হয়েছে। কিন্তু পুলিশ এফআইআর দায়ের করে খুনের তদন্ত শুরু করেনি।
সহদেবের আইনজীবী মেহেবুব আহমেদ এ দিন আদালতে জানান, পুলিশ তদন্ত শুরু না করায় তাঁর মক্কেল জঙ্গিপুর আদালতের ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে চলতি বছরের ১৭ এপ্রিল অভিযোগ জানান। ম্যাজিস্ট্রেট ওই দিনই পুলিশ নির্দেশ দেন, এফআইআর দায়ের করে তদন্ত শুরু করতে। পুলিশ গত ২৬ এপ্রিল এফআইআর দায়ের করলেও, খুনের তদন্ত শুরু করেনি। সেই কারণেই হাইকোর্টে পুলিশি নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগ জানিয়ে মামলা দায়ের করেন সহদেব।
ওই আইনজীবী আদালতে জানান, গত চার বছরে ওই গ্রামের বাসিন্দা শিবায়ন মণ্ডল, দীনু মণ্ডল, রবি মণ্ডল, সীতা মণ্ডলও প্রথমে নিখোঁজ ছিলেন। পরে তাঁদের দেহ উদ্ধার করে পুলিশই। আইনজীবী আরও জানান, ওই গ্রামের বাসিন্দা জ্যোৎস্না মণ্ডল তিন বছর ধরে নিখোঁজ। তাঁর খোঁজ এখনও মেলেনি। শেষে সহদেবের সঞ্জয়েরও একই পরিণতি হওয়ার পরে গ্রামের বেশ কয়েক জন বাসিন্দা গত ১৫ জুন জেলাশাসক, মহকুমাশাসক, পুলিশ সুপার, রাজ্য পুলিশের ডিআইজি (মুর্শিদাবাদ রেঞ্জ), এমনকী রাজ্যের স্বরাষ্ট্র সচিবের কাছেও স্মারকলিপি দিয়ে বিস্তারিত জানান। তারপরেও থানার পুলিশ বা সিআইডি পাঁচটি খুনের তদন্ত শুরু করেনি। খোঁজ করেনি জ্যোৎস্না মণ্ডলেরও।
আইনজীবী মেহেবুব এর পরে আদালতে জানান, মুর্শিদাবাদের জেলাশাসক ওই স্মারকলিপি পেয়ে গত ৩ জুলাই পুলিশ সুপারের কাছে ঘটনার রিপোর্ট চান। কিন্তু পুলিশ সুপার সেই রিপোর্ট জেলাশাসককে দিয়েছেন কি না, তা জানা যায়নি। বিচারপতি দত্ত তা জেনে জিপি অভ্রতোষ মজুমদারের উদ্দেশে বলেন, ‘‘পাঁচ জনের রহস্যজনক মৃত্যুর ব্যাপারে পুলিশ কী তদন্ত করেছে, জেলাশাসক নিজে তা পুলিশ সুপারের কাছে জানতে চেয়েছেন। অভিযোগ উঠেছে খুনের। পুলিশ কী তদন্ত করেছে সেই ব্যাপারে পুলিশ সুপারকে আদালতে রিপোর্ট দিতে হবে।’’ মামলার পরবর্তী শুনানি ধার্য হয়েছে ৮ সেপ্টেম্বর।
বাংলাদেশ সীমান্ত লাগোয়া সেকেন্দ্রা গ্রাম পঞ্চায়েতের লালখাঁদিয়ার এলাকাটি দীর্ঘ দিন ধরেই রাজনৈতিক সন্ত্রাস কবলিত এলাকা বলে চিহ্নিত। এক সময় রাজনৈতিক হানাহানি ও বোমাবাজির জন্য তটস্থ থাকত এলাকা। হাজার হাজার বোমা উদ্ধার হয়েছে গত কয়েক বছরে। রাজ্যে যে যখন শাসন ক্ষমতায় থেকেছে সেই দল ছাড়া বিরোধী দল সেখানে রাজনীতি করার ছাড়পত্র পায় না অভিযোগ। পঞ্চায়েতেও শাসক দলের প্রার্থীরাই বরাবর বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হয়ে এসেছে এখানে।
কিন্তু মৃত সঞ্জয় মণ্ডল বা তাঁর পরিবার রাজনীতির সঙ্গে কখনই যুক্ত ছিলেন না। সঞ্জয় ইলেকট্রিকের মিস্ত্রির কাজ করতেন বিভিন্ন বাড়িতে। গ্রামে একটা দোকানও খোলে সে তাঁর মৃত্যুর পর থেকে সে দোকান বন্ধ। ছ’ভায়ের মধ্যে সঞ্জয় অবিবাহিত। দু’ভাই মারা গিয়েছেন। গ্রামে ভাল ছেলে হিসেবেই পরিচিত সঞ্জয় ও তাঁর দাদা সহদেবরা। সঞ্জয় এ বছরের ৪ মার্চ সুতির আলমপুর এলাকায় কাজে যায়। রাতে বাড়ি ফেরেনি। পর দিন তাঁর দেহ মেলে আলমপুর এলাকার পাশে।
গ্রামের আর যাঁরা নিখোঁজ হয়েছেন, তাঁদের কেউ সব্জি বিক্রেতা, কেউ বা মৎস্যজীবী। সকলেই গরিব ঘরের। এঁদের সঙ্গে কারও শত্রুতা ছিল না বলে জানিয়েছেন গ্রামের অনেকেই। অনেকেরই পচাগলা দেহ মিলেছে ঘটনার তিন-চার দিন পরে। পুলিশ বলছে, ময়না-তদন্তের রিপোর্টেও অস্বাভাবিক মৃত্যু ছাড়া খুন বলে তেমন কিছু বলা হয়নি।