টেস্ট টিউব বেবি অর্থাৎ, আইভিএফ পদ্ধতিকে ঘিরে বাণিজ্যিকরণ বেড়ে গিয়েছে বলে কবুল করল স্ত্রীরোগ চিকিৎসকদের সংগঠন। সংগঠনের একাধিক কর্তাই জানিয়েছেন, এক দিকে সন্তানের জন্ম দেওয়ার ক্ষেত্রে আইভিএফ পদ্ধতি বেছে নেওয়ার ব্যাপারে তাড়াহুড়ো করছেন বহু দম্পতি। অন্য দিকে, সেই তাড়াহুড়োর সুযোগ নিয়ে চিকিৎসকদের একাংশও কোনও রকম কাউন্সেলিং ছাড়াই তড়িঘড়ি আইভিএফ-এ ঝুঁকছেন। স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় সন্তানের জন্ম দেওয়ার ক্ষেত্রে যে অপেক্ষাটুকু দরকার, বহু ক্ষেত্রে সেটাও হচ্ছে না। ফলে লক্ষ লক্ষ টাকার আর্থিক খরচের পাশাপাশি শারীরিক হয়রানিও হচ্ছে বিস্তর।
বেঙ্গল গাইনেকোলজিক্যাল অ্যান্ড অবস্টেট্রিক সোসাইটির সহ-সভাপতি দিব্যেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘আমরা সংগঠনের তরফে বারবার এটা বলছি। কিন্তু তার পরেও অনেকে শুনছেন না। চিকিৎসকেরা যদি আর একটু সময় দেন, কাউন্সেলিং করেন তা হলে এই সমস্যাটা অনেকটাই কমতে পারে।’’ তাঁর কথায়, ‘‘যে দম্পতিরা আইভিএফ করান, তাঁদের একটা বড় অংশই কিন্তু সচ্ছল নন। এমনকী বাড়ি পর্যন্ত বন্ধক রেখে তাঁরা চিকিৎসা করান। অথচ সব ক্ষেত্রে সেটার দরকারই নেই। বড় বেশি বাণিজ্যিকরণ হয়ে যাচ্ছে। ডাক্তারদের মানবিক মুখটা আরও বেশি করে সামনে আসা জরুরি।’’
বিশেষজ্ঞদের মতে, সন্তানের জন্য যে কোনও দম্পতির অন্তত এক বছর স্বাভাবিক ভাবে চেষ্টা করা উচিত। তার পরেও না হলে বিভিন্ন পরীক্ষা করে সমস্যা কোথায়, তা খুঁজে বার করে তা নিরাময়ের চেষ্টা দরকার। তার পরের ধাপে রয়েছে ল্যাপারোস্কোপি। তাতেও ব্যর্থ হলে ইন্ট্রা ইউটেরাইন ইনসেমিনেশন ও একেবারে শেষ বিকল্প হিসেবে রয়েছে আইভিএফ পদ্ধতি অর্থাৎ, টেস্ট টিউব বেবি।
স্ত্রীরোগ চিকিৎসক মল্লিনাথ মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘আমার কাছে এমন বেশ কয়েকটি উদাহরণ রয়েছে, যেখানে একাধিক বার আইভিএফ-এ ব্যর্থ হওয়া মহিলাও স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় সন্তানের জন্ম দিয়েছেন। আসলে ঠিক সময়ে তাঁদের সমস্যাটা নির্ণয় করে তার সমাধানের চেষ্টা হয়নি।’’
চিকিৎসকদের একটা অংশ মনে করছেন, ইদানীং অপেক্ষাকৃত বেশি বয়সে বিয়ে করার প্রবণতা বেড়েছে। তা ছাড়া পেশাগত কারণে অনেক সময়েই দম্পতিরা আলাদা জায়গায় থাকেন। তাই বহু ক্ষেত্রে তাঁরাও আইভিএফ-এর জন্য তাড়াহুড়ো করেন। কোন পরিস্থিতিতে আইভিএফ-ই একমাত্র পন্থা হয়ে উঠতে পারে, সে ব্যাপারে তাঁদের স্পষ্ট ধারণাই থাকে না। তাই চিকিৎসকদেরই দায়িত্ব তাঁদের কাউন্সেলিং করা।
স্ত্রীরোগ চিকিৎসক অভিনিবেশ চট্টোপাধ্যায় অবশ্য দম্পতিদের একাংশের তাড়াহুড়োকেই এ জন্য মূল দায়ী করেছেন। তিনি জানান, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার স্পষ্ট নির্দেশিকাই রয়েছে যে অন্তত দু’বছর চেষ্টার পরেও সন্তান না হলে তখন বিকল্প পদ্ধতির কথা ভাবা যেতে পারে। কিন্তু ইদানীং দেখা যাচ্ছে, বিয়ের তিন মাস বা ছ’মাসের মধ্যেই বহু দম্পতি আইভিএফ-এর কথা ভাবছেন। কারও ক্ষেত্রে কেরিয়ার, কারও ক্ষেত্রে পারিপার্শ্বিক চাপ কারও বা স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার মধ্যে ঢোকার অনিচ্ছাই অন্যতম কারণ হয়ে ওঠে। তিনি বলেন, ‘‘দম্পতিরা নিজেদের জায়গায় অনড় হয়ে থাকলে ডাক্তারদেরও অনেক সময় কিছু করার থাকে না।’’
আইভিএফ-এর ক্ষেত্রে সাফল্যের হার এখনও মাত্র ৩০ শতাংশ। বহু ক্ষেত্রে এক বারে না হলে একাধিক বার চেষ্টা করেন দম্পতিরা। ফলে বিপুল অর্থ ব্যয় তো হয়ই, পাশাপাশি নানা ধরনের ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও মারাত্মক হয়ে ওঠে বহু মহিলার ক্ষেত্রে।
বন্ধ্যত্ব চিকিৎসক সুদর্শন ঘোষ দস্তিদার বলেন, ‘‘কিছু কিছু ক্ষেত্রে পরিস্থিতি এমনই হয় যে যত তাড়াতা়ড়ি সম্ভব আইভিএফ করিয়ে নেওয়া দরকার। কিন্তু এমন কিছু ক্ষেত্রে আইভিএফ হচ্ছে যা হওয়ার কথাই নয়। যেমন পলিসিস্টিক ওভারি থাকলেও অনেকে আইভিএফ করাচ্ছেন। এটা পুরোপুরি ভুল। গোটা বিষয়টির বাণিজ্যিকরণ শুরু হয়েছে। এটা ঠেকাতে না পারলে সমূহ সর্বনাশ।’’