—ফাইল চিত্র।
দক্ষিণ কলকাতার আদিগঙ্গার প্লাবন রুখতে পুরসভার প্রস্তাবিত ব্যারাজ প্রকল্পের বিরুদ্ধে সরব হলেন পরিবেশবিদ ও নদী বিশেষজ্ঞেরা। দহিঘাটে ১৩৪ কোটি ৮৫ লক্ষ টাকা ব্যয়ে আধুনিক ব্যারাজ ও পাম্পিং স্টেশন তৈরির যে সিদ্ধান্ত কলকাতা পুরসভা নিয়েছে, তাকে আদিগঙ্গার ‘মৃত্যু পরোয়ানা’ হিসাবে দেখছেন আন্দোলনকারীরা। এই প্রকল্পের প্রতিবাদে এবং আদিগঙ্গাকে আদি রূপে ফিরিয়ে দেওয়ার দাবিতে গড়ে তোলা হয়েছে ‘আদিগঙ্গা বাঁচাও আন্দোলন’ কমিটি। তবে নিজেদের প্রকল্প নিয়ে আশ্বস্ত কলকাতা পুরসভা। তাদের দাবি, এই প্রকল্প কার্যকর হলে আদিগঙ্গা দূষণমুক্ত হবে। সঙ্গে যে আদিগঙ্গা এখন নোংরা জলে ভরে থাকে সারা বছর, সেই গঙ্গা দিয়ে প্রবাহিত হবে স্বচ্ছ জল।
মুখ্যমন্ত্রীর বাসভবন ও কালীঘাট মন্দির সংলগ্ন এলাকায় জোয়ারের সময় জলমগ্ন হওয়ার পরিস্থিতি কাটাতে দইঘাটে গঙ্গা ও টালিনালার সংযোগস্থলে ব্যারাজ তৈরির পরিকল্পনা করেছে পুরসভা। কিন্তু নদী বিশেষজ্ঞদের মতে, জোয়ার-ভাটার স্বাভাবিক ছন্দ ব্যাহত হলে এই প্রাচীন জলপথের অস্তিত্ব পুরোপুরি বিলীন হয়ে যাবে। কমিটির আহ্বায়ক তাপস দাস স্পষ্ট জানিয়েছেন, নিম্ন অববাহিকায় এ ধরনের ব্যারাজ নির্মাণে হিতে বিপরীত হবে।
তাদের প্রধান লক্ষ্যগুলি হল:
* বিশেষজ্ঞ কমিটি: বিজ্ঞানী ও পরিবেশবিদদের নিয়ে গবেষণার মাধ্যমে প্রকল্পের দীর্ঘমেয়াদি কুফল সাধারণ মানুষের কাছে তুলে ধরা।
* কনসেপ্ট নোট: প্রকল্পের পরিবেশগত ও সামাজিক প্রভাব নিয়ে তিন স্তরের (বুলেট পয়েন্ট, এক পাতা এবং বিস্তারিত প্রতিবেদন) একটি নীতিপত্র তৈরি করা।
* গণআন্দোলন: জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে সাংবাদিক সম্মেলন এবং ১০ জানুয়ারি কনভেনশনের ডাক দেওয়া হয়েছে। পোস্টার ও সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে জনমত গঠন করা হবে।
আন্দোলনকারীদের দাবি, ব্যারাজ হলে পলি জমে নালা বুজে যাবে এবং জলজ বাস্তুসংস্থান নষ্ট হবে। তাঁদের দাবি, ‘‘ব্যারাজটি তৈরি হলে আদিগঙ্গা পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যাবে, আমরা এই ধ্বংস রুখতে চাই।’’ কমিটির মতে, সংস্কারের নামে কৃত্রিম কাঠামো তৈরি না করে নদীর স্বাভাবিক গতিপথ ও নাব্যতা ফেরানোই একমাত্র স্থায়ী সমাধান। ইতিমধ্যেই এই আন্দোলনের জন্য একটি প্রস্তুতি কমিটি গঠন করা হয়েছে। উন্নয়নের নামে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্টের এই সরকারি পদক্ষেপের বিরুদ্ধে আগামী দিনে বড়সড় লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছে ‘আদিগঙ্গা বাঁচাও আন্দোলন’।
আন্দোলন কমিটির আহ্বায়ক তাপস বলেন, ‘‘আদিগঙ্গার মতো নিম্ন অববাহিকায় এই ধরনের ব্যারাজ নির্মাণ কখনও সফল হতে পারে না। আমাদের এই আন্দোলনের মঞ্চে বিজ্ঞানী, নদী বিশেষজ্ঞ, পরিবেশবিদ, পরিবেশকর্মীরা রয়েছেন। তাঁরা বিষয়টি নিয়ে গবেষণা করার পর মতামত দিচ্ছেন যে, এই ব্যারাজটি তৈরি হয়ে গেলে আদিগঙ্গা পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যাবে। আমরা এই ধ্বংস রোধ করতে চাইছি। কাজ শুরুর আগে এই বিষয়টি নিয়ে ফের বিবেচনা করুক কলকাতা পুরসভা।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘কলকাতায় মেট্রো রেল তৈরির সময় টালি নালার উপর যে সব সেতু তৈরি হয়েছিল, তার ফলে বর্তমানে দুরবস্থা হয়েছে টালিনালার। এর পর দুই ঘাটে ব্যারাজ তৈরি হলে আদিগঙ্গা পুরোপুরি ধ্বংসের মুখে চলে যাবে।’’
জবাবে মেয়র পারিষদ (নিকাশি) তারক সিংহ বলেছেন, ‘‘যাঁরা আদিগঙ্গা বাঁচানোর নামে আন্দোলন করতে চলেছেন, তাঁদের আমি আলোচনায় বসার প্রস্তাব দেব। আমরা যে কলকাতার আদিগঙ্গা ধ্বংস করছি না, বা পরিবেশ দূষণ বাড়াতে এই ধরনের কাজ করছি না, তা-ও হাতে-কলমে বুঝিয়ে দিতে পারব। অনেক গবেষণা, সমীক্ষা চালানোর পর ওই ব্যারাজটি তৈরির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘গড়িয়া থেকে দহিঘাট আদি গঙ্গার দৈর্ঘ্য ১৫ কিলোমিটার। নতুন যে ব্যারাজ তৈরি হবে, তার ফলে বিপুল জলরাশি কালীঘাট, কুঁদঘাট-সহ বেশ কিছু এলাকা প্লাবিত করতে পারবে না। নতুন প্রকল্প কার্যকর হলে অতিরিক্ত স্বচ্ছ জল আমরা ধরে রাখতে পারব। এখানে লকগেট কাম পাম্পিং স্টেশন তৈরি হচ্ছে। ফলে রিভার স্লুইস দিয়ে পরিষ্কার জল ঢোকানো সম্ভব হবে। ফলে এখন আদিগঙ্গায় যে নোংরা জল দেখা যায়, তা আর দেখা যাবে না। বদলে স্বচ্ছ জল গঙ্গা দিয়ে প্রবাহিত হবে। এর ফলে কেওড়াতলা মহাশ্মশান ও সিরিটি শ্মশানে যাঁরা শবদাহ করতে আসেন, তাঁদের সবচেয়ে বেশি উপকার হবে। এমনিতেই গঙ্গা অ্যাকশন প্ল্যানে গঙ্গা দূষণ কমানোর চেষ্টা হচ্ছে, নতুন করে এই ব্যারাজটি তৈরি হয়ে গেলে আদিগঙ্গা আর দূষিত থাকবে না।’’