কলকাতার বাড়িতে জুডিথ। ছবি: রণজিৎ নন্দী
খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু ফোন করলেও তিনি বলছেন, ‘‘চার-পাঁচদিন পরে আয়। জমিয়ে বসে কথা বলব।’’ জুডিথ ডিসুজা আসলে এখন ভীষণ ভাবে চাইছেন, শুধুমাত্র তাঁর বাবা-মা, দাদা-দিদির সঙ্গে একান্তে চার-পাঁচটা দিন কাটাতে।
আফগানিস্তানে অপহরণকারীদের ডেরায় দেড় মাস কাটিয়ে গত শুক্রবার মুক্তি পাওয়া জুডিথ তাঁর বাবা ডেনজিল ডিসুজা-কে ফোনে আগেই জানিয়েছিলেন, তিনি বিশ্রাম নিতে চান। একেবারে ঘনিষ্ঠ কেউ ছাড়া আর কারও সঙ্গে কথাও বলতে চান না। রবিবার রাত পৌনে আটটা নাগাদ নীল কামিজ-কালো শ্রাগ পরা জুডিথ তাঁর দাদা জেরমের সঙ্গে কলকাতার সিআইটি রোডের বাড়িতে যখন ঢুকছেন, তখন সেখানে রয়েছেন শুধু বাবা-মা আর দিদি। পুলিশি ঘেরাটোপে বাড়িতে ঢোকার সময়ে সাংবাদিকদের কোনও প্রশ্নেরই উত্তর দেননি জুডিথ। তবে জেরম বলেছেন, ‘‘ও খুব দুর্বল। ওর ‘বেড রেস্ট’ দরকার।’’
রবিবার সন্ধে সাতটা নাগাদ ইন্ডিগোর উড়ানে দিল্লি থেকে কলকাতায় আসেন জুডিথ ও তাঁর দাদা। কলকাতা বিমানবন্দরে সাধারণত যে গেট দিয়ে যাত্রীরা বেরোন, এ দিন সেখানেই জুডিথের অপেক্ষায় ছিল সংবাদমাধ্যম। শনিবার জুডিথ যখন কাবুল থেকে দিল্লি বিমানবন্দরে নামেন, তখন সংবাদমাধ্যমের ঠাসা ভিড় দেখে কিছুটা ঘাবড়ে গিয়েছিলেন। যা দেখে তাঁর বাবা আক্ষেপ করেছিলেন, নিজের দেশে ফিরেও কেন নিরাপত্তার অভাব বোধ করতে হবে জুডিথকে? কলকাতায় এ দিন সংবাদমাধ্যমকে এড়িয়ে অন্য গেট দিয়ে জুডিথকে কার্যত ভিআইপি নিরাপত্তায় বের করে নিয়ে যাওয়া হয়। বিমানবন্দর থেকেই অবশ্য বাড়িতে ফোন করেছিলেন জুডিথ। তার পর আগাগোড়া পুলিশি নিরাপত্তায় মেয়ে বাড়ি না পৌঁছনো পর্যন্ত মাঝেমধ্যেই বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গিয়েছে বাবা-মাকে।
জুডিথের বাবা ডেনজিল বলছিলেন, ‘‘দেশে ফিরেই প্রথম ও যখন আমাকে ফোন করল, তখন বলেছিল— তোমাদের সঙ্গে থাকতে চাই। মায়ের রান্না খাবার খাব আর ঘুমোব। আমরা চাইলে এক সপ্তাহের জন্য কলকাতার বাইরে কোথাও যেতেই পারতাম। কিন্তু সমস্যা তো আমাকে নিয়ে। আমাকে সপ্তাহে তিন দিন ডায়ালিসিস নিতে হয়। ফলে, দুম করে বাইরে চলে যাওয়া সম্ভব নয়।’’
দেশে-বিদেশে যেখানেই গিয়েছেন, জুডিথের বরাবরের পছন্দের মেনু, ভাত-ডাল-মুরগির মাংস। পারিবারিক সূত্রের খবর, গত ৯ জুন কাবুলের রাস্তা থেকে অপহরণের পর দুষ্কৃতী-ডেরায় জুডিথকে খেতে দেওয়া হতো স্থানীয় আফগান গ্রামের খাবারদাবার। অপহরণকারীরা অবশ্য তাঁর উপরে কোনও অত্যাচার করেনি। কিন্তু খাবারের পরিমাণটা ছিল বেশ কম। মুখেও রুচত না সেই খাবার। তার উপর যে এলাকায় তাঁকে আটকে রাখা হয়েছিল, সেখানে পানীয় জলের খুব টানাটানি। ফলে দেড় মাস ধরে তেষ্টাটাও ঠিকমতো মেটেনি তাঁর। ডেনজিল বলছেন,‘‘বেশ রোগাই হয়ে গিয়েছে আমার মেয়েটা।’’
প্রাণান্তকর ধকল শেষে এখন তাই দিনকতক বাড়িতে শুধুমাত্র পরিবারের সঙ্গেই কাটাতে চাইছেন জুডিথ। এই বিশ্রামটুকুর পর সবার সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করবেন বলে ঠিক করেছেন। ছোটবেলায় শিয়ালদহ লরেটোয় পড়ার সময়ে শিক্ষিকা সিস্টার সিরিল-কে দেখে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন সমাজসেবায়। সেই সিস্টার সিরিল এ দিন ফোনে বলেছেন, ‘‘আমি জানি, ও সুবিধে মতো এক দিন আমার সঙ্গে এসে ঠিকই দেখা করবে।’’
রবিবার সন্ধেয় বিমানবন্দরে বিজেপির বেশ কিছু নেতা-নেত্রীও এসেছিলেন। পরে তৃণমূল সাংসদ ডেরেক ও’ব্রায়েন এক বিবৃতিতে বলেছেন, ‘‘জুডিথের পরিবার অনুরোধ করেছে, তাঁদের ব্যক্তিগত গোপনীয়তার অধিকারকে যেন সম্মান করা হয়। জুডিথ ফেরায় আনন্দ হচ্ছে, স্বস্তি হচ্ছে। আবার কেউ কেউ এর মধ্যেও রাজনীতিক ফায়দা খুঁজছেন দেখে দুঃখ হচ্ছে।’’
রবিবার বাড়িতে কোনও বিশেষ উৎসব? ডেনজিল জানালেন, জুডিথের সবচেয়ে প্রিয় চিকেন কারি দিয়ে ডিনার ছাড়া আর বলার মতো কিছু নেই।