‘কেবল মনে পড়ে যাচ্ছিল বিল্টুর ওই ছোট্ট শরীরটা আর ওর কান্নার আওয়াজ’

ধাতস্থ হতে মিনিটখানেক সময় লাগে। তার পরে ফের এক বার সাহস করে জানলার পাশে আসি। পর্দা তুলে দেখি, বাইরেটা কিছুই দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। কালো ধোঁয়ায় ভরে গিয়েছে চার দিক।

Advertisement

টিঙ্কু সেনগুপ্ত (বিস্ফোরণের প্রত্যক্ষদর্শী)

শেষ আপডেট: ০৩ অক্টোবর ২০১৮ ০৩:১৮
Share:

টিঙ্কু সেনগুপ্ত।

নীচে নেমে উল্টো দিকের দোকান থেকে ফুল আর ঠাকুরের মিষ্টি কিনতে যাব। নীচে যাওয়ার আগে ভাবলাম, জানলার পর্দাটা তুলে দিয়ে যাই। ঘরে আলো আসবে। যেই জানলার পর্দাটা তুলেছি, অমনি বিশাল একটা শব্দে যেন কেঁপে উঠল চার দিক। আমি জানলার পাশ থেকে ছিটকে সরে এলাম। প্রথমে মনে হল, তীব্র ভূমিকম্প হয়েছে। আমাদের ফ্ল্যাটটা কাঁপছিল। আমার স্বামী মাটিতে শুয়ে ছিলেন। মেয়ে শুয়ে ছিল খাটে। মেয়ে খাট থেকে প্রায় ছিটকে পড়ে। আমার স্বামীও ছিটকে যান। এত জোরে আওয়াজ হয় যে, প্রথমে কিচ্ছু শুনতে পাচ্ছিলাম না।

Advertisement

ধাতস্থ হতে মিনিটখানেক সময় লাগে। তার পরে ফের এক বার সাহস করে জানলার পাশে আসি। পর্দা তুলে দেখি, বাইরেটা কিছুই দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। কালো ধোঁয়ায় ভরে গিয়েছে চার দিক। আমাদের বাড়ির জানলা দিয়েও ধোঁয়া ঢুকছিল। আর একটা পোড়া গন্ধ। বুঝতে পারি, আমাদের ফ্ল্যাটের ভিতরে নয়, নীচে কিছু একটা হয়েছে। ওই কালো ধোঁয়ায় ভরে থাকা অন্ধকারের মধ্যেই শুনতে পাচ্ছিলাম একটা বাচ্চার কান্নার আওয়াজ। দেখলাম, পাড়ার বছর আটেকের বিভাস, যাকে আমরা বিল্টু নামেই চিনি, ‘বাবা গো, মা গো’ বলে চিৎকার করছে। ওর শরীরটা এতটাই ঝলসে গিয়েছে যে, চামড়ার ভিতরের মাংস বেরিয়ে গিয়েছে। তার মধ্যে কেউ এক জন ওর গায়ে জল ঢেলে দিচ্ছে। কে জল ঢালছে, তা অবশ্য বুঝতে পারিনি।

ওই দৃশ্য দেখে আমরা আর স্থির থাকতে পারিনি। আমি ও আমার স্বামী দ্রুত সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে আসি। এত দিন সিনেমায় দেখেছি, কোথাও বোমা বিস্ফোরণ হলে কী ভাবে জখম মানুষজন যন্ত্রণায় পড়ে কাতরাতে থাকেন। এ বার সেই দৃশ্যই নিজের চোখে দেখলাম। আমার হাত পা-ও থরথর করে কাঁপছিল। দেখি, আমার সামনেই এক ফলওয়ালা মাটিতে উপুড় হয়ে পড়ে আছেন। হাত তুলে নাড়াচ্ছেন। মাথাটা তুলে চার দিকে তাকানোর চেষ্টা করছেন। এর পরেই ওঁর মাথাটা পাথরে ঠুকে স্থির হয়ে গেল। বোধহয় অজ্ঞান হয়ে গেলেন। এক জন মহিলা পা মেলে মাটিতে বসে ছিলেন। দেখলাম, রক্তে ভেসে যাচ্ছে তাঁর শরীর। পাড়ার দোকানের সামনে বেঞ্চে যাঁরা বসে ছিলেন, তাঁদের কয়েক জনের দেখলাম, পায়ের পেশি থেকে মাংস ঝুলে পড়েছে।

Advertisement

এর পরে আমরা স্থানীয় বাসিন্দারাই উদ্ধারকাজ শুরু করি। অ্যাম্বুল্যান্স তো আসতে একটু সময় লাগবে। তাই আমরা ভ্যান জোগাড় করে আহতদের তাতে তুলতে শুরু করলাম। আমাদের বাড়ির কাছেই একটা হাসপাতালে ওঁদের নিয়ে যাই। অ্যাম্বুল্যান্সে করে একের পরে এক আহতকে নিয়ে আসা হচ্ছিল ওই হাসপাতালে। বিল্টুকেও সেখানেই প্রথমে নিয়ে আসা হয়। আমরা হাসপাতালে কিছু ক্ষণ থেকে তার পরে চলে আসি। কেবল মনে পড়ে যাচ্ছিল বিল্টুর ওই ছোট্ট শরীরটা আর ওর কান্নার আওয়াজ। বিল্টুকে আমরা ছোট থেকে দেখছি। ওর মা এই পাড়ায় কাজ করেন। পরে জানলাম, ও মারা গিয়েছে। যে বা যাদের জন্য এ রকম একটা অবোধ শিশুকে বেঘোরে মারা যেতে হয়, তাদের যেন ঈশ্বর কোনও দিন ক্ষমা না করেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন