সাধারণ কাজের দিনের দুপুর। সন্তোষপুর থেকে চাঁদনি চকে যেতে গাড়ির খোঁজ করতেই ক্যাবের অ্যাপ জানিয়ে দিল, ‘ডিমান্ডস আর হাই’। অঘোষিত বক্তব্য, সেই কারণেই ভাড়া বেশি। গাড়িতে উঠতেই চালক অবশ্য চমকে দিয়ে বললেন, ‘‘সারা দিন ঘুরছি। ভাড়া নেই। আপনিই প্রথম!’’ তা হলে ‘ডিমান্ডস আর হাই’ কীসের ভিত্তিতে?
অফিসে যাওয়ার প্রবল তাড়া। কসবার রথতলা থেকে সময়মতো অ্যাপ-ক্যাব বুক করেও বাড়ির নীচে দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষায় এক তরুণী। কিছু ক্ষণ পরে হঠাৎ দেখলেন, প্রথমে যে চালক আসছিলেন, তিনি বদলে গিয়েছেন। ক্যাব সংস্থাই নতুন চালককে দিয়েছে। দেখা গেল, নতুন গাড়ির সঙ্গে ওই যাত্রীর দূরত্ব আগের গাড়িটির থেকেও বেশি। অগত্যা ‘রাইড’ বাতিল করে নতুন করে ক্যাব বুক করতে হল তাঁকে। এ বারও চালক বদলে গেলেন। এ ভাবে চার বার চালক ও গাড়ি বদলের পরে গন্তব্যে রওনা দিতে পারলেন ওই তরুণী। তত ক্ষণে ২০ মিনিটেরও বেশি সময় কাবার!
উল্টোডাঙা থেকে যাদবপুর যাবেন বলে অ্যাপ-ক্যাব নিতে গিয়ে আর এক যাত্রী দেখলেন, একটি সংস্থা ভাড়া চাইছে ৫১০ টাকা! অন্য একটি অ্যাপ-ক্যাব সংস্থা আবার ওই দূরত্বের জন্যই চাইছে ২৩০ টাকা। বিস্মিত গ্রাহকের প্রশ্ন, ‘‘একই দূরত্বের জন্য ভাড়ায় এত ফারাক হয় কী করে! সার্জ প্রাইসেও তো একটা সাযুজ্য থাকার কথা। সবই কি ওদের ইচ্ছেমতো হবে?’’
দুর্ভোগের এই তালিকা নেহাত ছোট নয়। অ্যাপ-ক্যাবের ‘ঝোপ বুঝে কোপ মারা’র এমন প্রবণতা দেখে বছর শেষে যাত্রীদের বড় অংশই বলছেন, ভাড়া নির্ধারণের বিষয়টি বাস্তব পরিস্থিতি বা যুক্তির ধার ধারে না। বছর আসে, বছর যায়। কিন্তু কলকাতায় অ্যাপ-ক্যাবের চরিত্র বদলায় না। পরিবহণ দফতরের নির্দেশেও কাজ হয় না। অভিযোগ, কখন ভাড়া বাড়ল, কেন বাড়ল, তা না জানেন গ্রাহক, না জানে পরিবহণ দফতর। এক যাত্রী তাঁর অভিজ্ঞতা থেকে জানাচ্ছেন, কয়েক মাস ধরে নির্দিষ্ট দূরত্বের জন্য অ্যাপ-ক্যাব নিচ্ছিলেন তিনি। তার পরেই এক দিন হঠাৎ ভাড়া বেড়ে যায়। ওই যাত্রীর কথায়, ‘‘ধরা যাক, পুল (ভাগাভাগির যাত্রা)-এ ৩৩ টাকা নিচ্ছিল। সেটাই হঠাৎ হয়ে গেল ৪৯ টাকা। কেন, কাকে জানিয়ে হল, তার কোনও ব্যাখ্যা নেই।’’ অনেকে বলছেন, দেশের অন্যান্য বড় শহরের চেয়ে কলকাতায় অন্তত ২০ শতাংশ বেশি ভাড়া গুনতে হয় অ্যাপ-ক্যাবে।
যাত্রীদের বড় অংশই কাঠগড়ায় তুলেছেন পরিবহণ দফতরকে। তাঁদের বক্তব্য, গত জুনে পরিবহণ দফতর অ্যাপ-ক্যাব সংস্থাগুলির সঙ্গে বৈঠক করেছিল। তাদের বলা হয়েছিল, কোন যাত্রীর থেকে ভাড়া এবং সার্জ বাবদ কত টাকা নেওয়া হয়েছে, প্রতি মাসের শেষে তা জানাতে হবে পরিবহণ দফতরকে। সেই সঙ্গে ক্যাব সংস্থাগুলিকে কথা দিতে হয়, সার্জ প্রাইস কখনওই মূল ভাড়ার দেড় গুণের বেশি হবে না। এমনকি, রাত ৮টার আগে কোনও ভাবেই সার্জ না নেওয়ারও কথা হয়। কিন্তু মাসের পর মাস ঘুরলেও সেই ‘মুখের কথা’র কোনও প্রয়োগ বাস্তবে দেখা যায় না। কোন যাত্রীর থেকে কত টাকা নেওয়া হয়েছে, তার হিসেব কে দেবে? সেই নথিই বা কোথায়? উত্তর নেই!
ক্যাব সংস্থাগুলি অবশ্য দায় চাপাচ্ছে একে অপরের উপরে। ওলা-র দাবি, সরকারের সঙ্গে বৈঠকের পরে তারা ‘মাইক্রো’ এবং ‘মিনি’ গাড়ির সার্জ কমিয়েছে। উব্র-এর বক্তব্য, তাদের সব ধরনের গাড়িতেই সার্জ রয়েছে। তবে অন্যদের তুলনায় তাদের গাড়ি বেশি এবং ভাড়া কম। কিন্তু কোন পদ্ধতিতে তারা ভাড়া নির্ধারণ করে, কেনই বা ভাড়া বাড়ে, কেনই বা তা কমে যায়— কোনও সংস্থাই তা জানাতে চায়নি! যাত্রীরাও বলছেন, ‘‘ওলা তাদের মাইক্রো বা মিনিতে ভাড়া কমানোর দাবি করলেও অন্য শ্রেণির গাড়িতে ভাড়া বাড়িয়ে রাখে। আর উব্রের গা়ড়ি বেশি থাকলেও নিজেদের মতো করে তারা ভাড়া বাড়িয়ে নেয়।’’
দুই সংস্থা পরস্পরের ঘাড়ে দায় চাপালেও প্রশাসন নীরব। পরিবহণমন্ত্রী শুভেন্দু অধিকারীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি ফোন ধরেননি। মেসেজেরও উত্তর দেননি। পরিবহণ দফতরের এক আধিকারিক বলছেন, ‘‘অবস্থা জটিল হলে তবেই আসরে নামেন পরিবহণমন্ত্রী।’’
তাতে কি সমস্যার সমাধান হয়? বছর শেষের অভিজ্ঞতা বলছে, না!