CAA

হাতে তেরঙা, প্রতিবাদে অটিস্টিক তরুণও

ট্রাউজার্সের পকেটের কাছে মুঠো করা ডান হাত। সারা শরীর কাঁপছে। সেই অবস্থাতেই কিছু একটা বলার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি। কিন্তু বলতে না পেরে ঘনঘন জাতীয় পতাকা নাড়ছেন। আর শক্ত করে আঁকড়ে ধরছেন পাশে দাঁড়ানো মহিলার হাত।

Advertisement

নীলোৎপল বিশ্বাস

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৮ জানুয়ারি ২০২০ ১১:০০
Share:

শামিল: মা ফারজানার সঙ্গে তৌফিক। শুক্রবার, পার্ক সার্কাস ময়দানে। নিজস্ব চিত্র

পরনে স্কুলের লাল-সাদা চেক শার্ট আর নীল ট্রাউজার্স। পিঠে ব্যাগ। ভিড়ের মধ্যে বছর কুড়ির তরুণের এমন চেহারা ‘অন্য রকম’। তবে তার চেয়েও বেশি ‘অন্য রকম’ তাঁর হাবভাব। বাঁ হাতে শক্ত করে ধরা জাতীয় পতাকা। ট্রাউজার্সের পকেটের কাছে মুঠো করা ডান হাত। সারা শরীর কাঁপছে। সেই অবস্থাতেই কিছু একটা বলার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি। কিন্তু বলতে না পেরে ঘনঘন জাতীয় পতাকা নাড়ছেন। আর শক্ত করে আঁকড়ে ধরছেন পাশে দাঁড়ানো মহিলার হাত।

Advertisement

‘‘উনি এমন করছেন কেন? ডাক্তার ডাকব?’’ গত ৭ জানুয়ারি থেকে পার্ক সার্কাস ময়দানে চলতে থাকা সিএএ-এনআরসি বিরোধী প্রতিবাদ অবস্থানে শুক্রবার ওই দৃশ্য দেখে প্রশ্নটা করেছিলেন প্রথম দিন থেকে সেখানে থাকা জিশান জইদ। যে মহিলার হাত আঁকড়ে ধরেছিলেন তরুণ, তিনি বললেন, ‘‘ও আমার ছেলে। স্পেশ্যাল চাইল্ড। এই প্রতিবাদে ও থাকতে চায়।’’ মুহূর্তে জায়গা ছেড়ে দেওয়া হল তরুণের জন্য। স্লোগান উঠল, ‘‘হাম লড়কে লেঙ্গে।’’ সকলে বললেন, ‘‘আজ়াদি।’’ তরুণ কথা বললেন না। স্রেফ শক্ত হাতে তুলে ধরলেন পতাকা।

তৌফিক নওয়াজ নামে বছর কুড়ির ওই তরুণের বাড়ি তপসিয়া এলাকায়। বাবা শেখ কাদের নওয়াজ রেলকর্মী। মা ফারজানা জানালেন, তৌফিক ছাড়াও তাঁর ১৫ বছরের একটি মেয়ে রয়েছে। তৌফিকেরা আদতে পূর্ব মেদিনীপুরের বাসিন্দা। তবে গত ১৫ বছর ধরে তাঁরা কলকাতায় রয়েছেন। ছেলের জন্যই শহরে চলে আসতে হয়েছিল কাদের আর ফারজানাকে। এখন পার্ক স্ট্রিট এলাকার বিশেষ চাহিদাসম্পন্নদের একটি বেসরকারি স্কুলে পড়েন তৌফিক। ফারজানার কথায়, ‘‘তৌফিক সিজ়ারিয়ান বেবি। তবে জন্মের পরে ওর সেপ্টিসেমিয়া হয়ে যায়। পরে জানা যায়, ও স্পেশ্যাল চাইল্ড। বহু ডাক্তার দেখিয়েছি। তাঁরা বলেছেন, ওর অটিজ়ম রয়েছে। সব কিছুই দেরিতে হবে। এর মধ্যেও প্রতিদিন ও খবরের কাগজ দেখে, টিভিতে খবর শোনে। সে সব শুনেই পার্ক সার্কাসের এই প্রতিবাদে আসবে বলে জেদ ধরে।’’

Advertisement

নিজে বার কয়েক পার্ক সার্কাসের প্রতিবাদ অবস্থানে যোগ দিলেও গত কয়েক দিন ছেলেকে কোনওমতে দূরে রেখেছিলেন ফারজানা। ছেলের স্কুল থেকে হাঁটাপথ পার্ক সার্কাস ময়দান। সকালে ছেলেকে স্কুলে দিয়ে ফারজানা চলে আসতেন প্রতিবাদ অবস্থানে যোগ দিতে। দুপুরে ছেলেকে নিয়ে বাড়ি ফিরতেন। কোনও কোনও দিন বাড়ির কাজ সেরে রাতে ফের আসতেন পার্ক সার্কাসে। তবে এ দিন স্কুল থেকে বেরিয়ে তৌফিক কার্যত চেঁচাতে শুরু করেন প্রতিবাদ সভায় যাবেন বলে। অবশ্য ছেলের জেদে প্রচ্ছন্ন মদত ছিল মায়েরও। ফারজানা বললেন, ‘‘সামনেই মেয়ের আইসিএসই পরীক্ষা। তৌফিকেরও শরীর ভাল নয়। তবু এত লোকের প্রতিবাদে ও থাকবে জেনে বাধা দিইনি। বরং এখানে এসে ওর জন্য গর্বই হচ্ছে। তৌফিক যেমনই হোক, নিজের মতো করে প্রতিবাদ করছে এটাই বড় কথা।’’

একই সঙ্গে তিনি বলেন, ‘‘ধর্মের দোহাই দিয়ে প্রধানমন্ত্রী দেশ ভাগ করার চেষ্টা করছেন। এখানে এসে তিনি দেখে যান, এই প্রতিবাদ কোনও একটি ধর্মের লড়াইয়ে আটকে নেই।’’ তবে রাজ্য সরকারের সাহায্য আরও আগে আসলে ভাল হত বলে মন্তব্য করলেন ফারজানা। তাঁর কথায়, ‘‘ঠান্ডা প্রায় চলে গেল, তার পরে মাথায় ছাউনি এল। তবে আমাদের লড়াই কোনও কিছুর জন্যই থেমে থাকবে না।’’

বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ছেলেকে মানুষ করা, সে-ও তো এক লড়াই..! থামিয়ে দিয়ে মায়ের মন্তব্য, ‘‘কোনটাকে এগিয়ে রাখব জানতে চান তো? আমি বলব দু’টোই সমান। এটা ভারতীয় হিসেবে অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই। জীবন রক্ষার লড়াই। ছেলে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন হওয়ায় লড়াইটা আমি একটু আগে শুরু করেছি, এই যা।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন