লাইন কোথায়! পরম শান্তিতে গান শুনছে আগরপাড়ার ব্যাঙ্ক

কাকভোরে ঘুম থেকে উঠে ব্যাঙ্কের সামনে কয়েক ঘণ্টা লাইনে দাঁড়ানোটা এখন গোটা দেশেরই প্রায় অভ্যাস হয়ে গিয়েছে। ব্যাঙ্কের সামনে লম্বা লাইন দেখে চোখও সয়ে গিয়েছে এই ক’দিনে।

Advertisement

শান্তনু ঘোষ

শেষ আপডেট: ১৮ নভেম্বর ২০১৬ ০৪:০০
Share:

ব্যাঙ্কের সামনে কুপন বিলি করছেন কাউন্সিলর। ছবি: সজল চট্টোপাধ্যায়।

কাকভোরে ঘুম থেকে উঠে ব্যাঙ্কের সামনে কয়েক ঘণ্টা লাইনে দাঁড়ানোটা এখন গোটা দেশেরই প্রায় অভ্যাস হয়ে গিয়েছে। ব্যাঙ্কের সামনে লম্বা লাইন দেখে চোখও সয়ে গিয়েছে এই ক’দিনে। কিন্তু আগরপাড়া নর্থ স্টেশন রোডের ইউনাইটেড ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়ায় সামনে কিন্তু অন্য ছবি। সকাল সাড়ে ন’টা, ব্যাঙ্ক খুলতে যখন আর মাত্র আধ ঘণ্টা বাকি, তখনও রাস্তা শুনশান। আজ নয়, গত আট দিন ধরেই।

Advertisement

তবে কি ওই ব্যাঙ্কে কি কোনও গ্রাহক নেই? নাকি টাকাকড়ির দরকার নেই এলাকার লোকজনের!

এই প্রশ্নের জবাব পেতে গেলে অপেক্ষা করতে হবে বেলা দশটা পর্যন্ত। তখন একে একে হাজির হবেন মানুষজন। হাতে কুপন নিয়ে। সেটাই নাকি সব শান্তির ওষুধ। ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষ, স্থানীয় কাউন্সিলর আর এলাকার যুবকদের মধ্যে আলোচনার ফসল এই দাওয়াই।

Advertisement

বৃহস্পতিবার সকালে আগরপাড়ার ওই ব্যাঙ্কের সামনে গিয়ে দেখা গেল রাস্তার উপরে প্রধান গেটের দু’দিকে চারশোটি চেয়ার ভাগাভাগি করে পাতা। এক দিকের চেয়ার প্রবীণ নাগরিকদের জন্য। বাকিদের জন্য বরাদ্দ অন্য দিকের চেয়ার। পানিহাটি পুরসভার স্থানীয় তৃণমূল কাউন্সিলর কৌশিক চট্টোপাধ্যায় জানালেন, প্রতিদিন ভোরে গ্রাহকেরা এসে দু’দিকের চেয়ারে বসে পড়েন। চলে আসেন তিনি নিজে এবং স্বেচ্ছাসেবকরা। সাড়ে আটটা বাজতে তাঁরাই প্রত্যেকের হাতে পৌঁছে দেন ক্রমিক নম্বর লেখা কুপন। প্রবীণ ও সাধারণ গ্রাহকদের কুপন আলাদা। তাতে কাউন্সিলর ও পানিহাটি পুরসভার নামের স্ট্যাম্প দেওয়া রয়েছে। তার উপরে সই করছেন কৌশিকবাবু।

কুপন দেওয়ার পরে বলে দেওয়া হয় কত নম্বর থেকে কত নম্বরের কুপন-মালিক কোন সময়ে লেনদেনের জন্য আসবেন। তাই সকালে কুপন নিয়ে বাড়ি চলে গিয়ে আবার নির্দিষ্ট সময়ে ব্যাঙ্কে আসেন গ্রাহকেরা। দশটায় ব্যাঙ্ক খোলার পর ফের সহায়তা ক্যাম্প থেকে বিলি হয় কুপন। সঙ্গে থাকে সিল করা জলের গ্লাস ও চা। চেয়ারে বসে চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে শোনা যাবে রবীন্দ্রসঙ্গীতও। নম্বর ঘোষণার মাঝেই বক্সে বাজানো হচ্ছে রবীন্দ্রসঙ্গীত।

ফলে প্রতিদিন কমবেশি ১২০০ গ্রাহক লেনদেন করলেও ব্যাঙ্কের বাইরে কোনও লম্বা লাইন নেই। গ্রাহকদের বিক্ষোভ সামাল দিতে আসতে হয়নি পুলিশকেও। বরং মাঝেমধ্যে সন্ধে হয়ে গেলে লাইনে থাকা গ্রাহকেরা পরের দিন আবার আসবেন বলে, হাসি মুখে ‘ছুটি’ দিচ্ছেন ব্যাঙ্কের কর্মীদের। আর তাই থানার অফিসারেরাও বলছেন, ‘‘ওখানে তো স্থানীয়েরাই সব সামলাচ্ছেন। তাই কোনও গণ্ডগোলও নেই, আমাদের দরকারও নেই।’’

কুপন ঘিরে যাতে জালিয়াতি না হয় সে জন্য প্রতিদিন বদলাচ্ছে কুপনের রং ও সাইজ। কখনও আবার নতুন কায়দায় সই করে দিচ্ছেন কাউন্সিলর। কৌশিকবাবু বললেন, ‘‘নকল ঠেকাতেই এই ব্যবস্থা।’’ তিনিই জানালেন, প্রথম দিন গ্রাহকদের খুব ভোগান্তি হয়েছিল। এর পরেই ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে কুপন সিস্টেম চালু হয়।

ঠিক কী পদ্ধতিতে কাজ চলছে? সকাল দশটার পর থেকে প্রতি ঘণ্টায় ১০০ কিংবা ১৫০ জন গ্রাহককে সময় দেওয়া হয়। ব্যাঙ্ক খুলতেই মাইকে পাঁচটি করে নম্বর ঘোষণা করেন ওই কাউন্সিলরের অনুগামী স্থানীয় যুবকেরা। সেই মতো গ্রাহকেরা কুপন জমা দিয়ে তবেই ব্যাঙ্কের ঢোকার গেট টপকাতে পারেন। এক গ্রাহক তাপস মজুমদার বলেন, ‘‘কুপন নিয়ে সময় জেনে নিয়ে চলে যাই। তাই লাইনের ঝামেলায় পড়তে হয় না। শুধু এসে দেখে নিই কত নম্বর ডাকা হল।’’ সময়ের মধ্যে আসতে না পারলেও অসুবিধা নেই, জানালেন আর এক কাউন্সিলর অনুপম দত্ত। তাঁর কথায়, ‘‘কেউ না এলে স্বেচ্ছাসেবকরা পরে আবার ওই নম্বর ডেকে নেন।’’ ব্যাঙ্কের সামনে বাতিস্তম্ভে ঝোলানো বক্সে এ দিনও শোনা গেল নম্বরের ঘোষণা। প্রবীণ ও সাধারণদের ভাগাভাগি করে নম্বর ডাকা হচ্ছে। টাকা শেষ হয়ে গেলে বা কমে এলে সেটাও জানিয়ে দেওয়া হচ্ছে মাইকেই। ফলে বাড়তি উদ্বেগ বা হতাশা জমতে পারছে না গ্রাহকদের মধ্যে।

আগরপাড়া স্টেশনের আশপাশের প্রায় দশটি পাড়ার ভরসা এই ব্যাঙ্ক। মোট গ্রাহকের সংখ্যা ৩৬ হাজার। বাইরে থেকে নোট বদল করার ভিড়ও আছে। তবু মসৃণ ভাবে কাজ হয়ে চলেছে।

ম্যানেজার দেবজ্যোতি মজুমদার বলেন, ‘‘কাউন্সিলর-সহ সব যুবকেরা এগিয়ে এসেছেন বলেই কোনও সমস্যা নেই। আর গ্রাহকেরাও খুব ভাল। না হলে কি আমাদের কষ্ট হচ্ছে দেখলেই বাড়ি যেতে বলেন!’’ তবে এলাকার লোকজন বলছেন, ‘‘ম্যানেজার সাহেব আমাদের অভিভাবক ও বন্ধুর মতো। তাই আমাদেরও কিছুটা কর্তব্য আছে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন