এর পরে কে, প্রহর গুনছে বৌবাজার

এখনও টিকে থাকা বাসিন্দারা ভাবছেন, এ বার কি বিপদ এগিয়ে আসবে তাঁদের পাড়াতেও? ধসে পড়বে তাঁদের বাড়ি? 

Advertisement

নীলোৎপল বিশ্বাস

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৯ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ০৩:১৬
Share:

চিন্তিত: বাড়ি ছাড়তে হবে না তো, এই আশঙ্কাতেই দিন কাটছে প্রভাত দাসের। রবিবার, মদন দত্ত লেনে। ছবি: সুমন বল্লভ

এর পরে কার পালা?

Advertisement

বৌবাজারের সরু গলিতে পুরনো কলকাতার গায়ে কাঁটার মতো বিঁধে প্রশ্নটা। শহুরে জনপদের নীচে মেট্রোর সুড়ঙ্গ খুঁড়তে যাওয়ায় ধসে যাচ্ছে একের পর এক পাড়া। এখনও টিকে থাকা বাসিন্দারা ভাবছেন, এ বার কি বিপদ এগিয়ে আসবে তাঁদের পাড়াতেও? ধসে পড়বে তাঁদের বাড়ি?

পুজোর আগে সাধারণত ছুটিতে প্রিয়জনের ফিরে আসার অপেক্ষা করে কলকাতার নিবিড় গৃহকোণ। কিংবা বাক্সপ্যাঁটরা গুছিয়ে বাঙালি তৈরি হয় বেড়াতে যাওয়ার জন্য। সেই জিনিসপত্র গোছানোর পালাই এখন চলছে বৌবাজারে, তবে বিঁধে থাকছে ঘরহারা হওয়ার আশঙ্কা। কেউ বাতিল করেছেন পুজোর পরে গ্যাংটক ঘুরতে যাওয়ার টিকিট। কেউ বা আত্মীয়দের ফোন করে বলেছেন, ‘‘কয়েকটা দিন তোমাদের বাড়ি গিয়ে আমাদের থাকতে হতে পারে। নয়তো জিনিসগুলো রেখে আসব।’’ স্ত্রীর তৈরি দোকান নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে পারে ভেবে এখন ওই দোকানেই রাতদিন ঠায় বসে থাকছেন জনৈক বৃদ্ধ।

Advertisement

গত রবিবার থেকে বৌবাজারের দুর্গা পিতুরি লেন ও সেকরাপাড়া লেনে একের পর এক বাড়ি ধসে পড়ার পরে দিন দুই আগে পাশের গৌর দে লেন থেকেও কয়েকটি পরিবারকে সরানো হয়েছে। বিপর্যয়ের আশঙ্কা চেপে বসেছে মদন দত্ত লেন, শশিভূষণ দে স্ট্রিট, পঞ্চাননতলা লেন বা হিদারাম ব্যানার্জি লেনেও। মদন দত্ত লেনের প্রভাত দাস ফোন কানে তারস্বরে চেঁচাচ্ছিলেন, ‘‘কয়েক দিন তোদের ওখানে গিয়ে থাকতে হতে পারে। সব গুছিয়ে রেখেছি। হ্যাঁ সব..!’’ একটু বাদে বললেন, ‘‘মেডিক্যাল কলেজের পাশেই বোনের বাড়ি। ওকে ফোনটা করে রাখলাম! যদি যেতে হয়!’’ হিদারাম ব্যানার্জি লেনের বাসিন্দা, আইনজীবী সুব্রত ভট্টাচার্যও সপরিবার বাড়ি ছাড়ার জন্য তৈরি। বললেন, ‘‘মেট্রোর গাফিলতি। মাটির নীচে সব কিছু কতটা ঠিক আছে, কতটা নড়বড়ে, কিছুই তো বোঝা যাচ্ছে না। গোটা বৌবাজারটাই না চাপা পড়ে যায়!’’

হিদারাম ব্যানার্জি লেনেরই এক ডাক্তারখানার সামনে জটলা। লোকজন নাগাড়ে মেট্রোর ‘মুণ্ডপাত’ করে চলেছেন। ভয় করছে কি না, জানতে চাওয়ায় এক জন বলে উঠলেন, ‘‘আমরা নয়, এ বার নেতা-মন্ত্রীরা ভয় পাবেন। সারা রাত ঘুমোতে পারছি না। এটা কি ছেলেখেলা হচ্ছে?’’ ডাক্তারখানার কম্পাউন্ডার বললেন, ‘‘কোনও রোগী আসছেন না। আসবেনই বা কী করে, বেশির ভাগই তো পাড়াছাড়া। আর যাঁরা আসছেন, তাঁরা বলছেন, ঘুমোতে পারছি না। বুক ধড়ফড় করছে। বুঝুন অবস্থা!’’ স্থানীয় হোটেল-মালিক বিষ্ণু সিংহের তিক্ত মন্তব্য, ‘‘এ তো কালিদাসের গল্প মশাই! যেখানে দাঁড়িয়ে, সেই পায়ের তলার মাটি কাটল ওরা? কেউ কখনও করে এমন!’’

কয়েক পা এগিয়েই পঞ্চাননতলা লেনের পিন্টু সাহা তবু আশায় আশায় বাঁচছেন। বললেন, ‘‘আমি সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। যা বুঝছি, মেট্রো কর্তৃপক্ষ ঠিক সামলে নেবেন। আমাদের আর ওঁদের মতো বাড়িছাড়া হতে হবে না।’’ বাড়ি ছাড়ার পরে কী হবে, অত দূর ভাবার ক্ষমতাই নেই সত্তরোর্ধ্ব নির্মল পালের। তাঁর চিন্তা, স্ত্রী মীরার হাতে তৈরি মুদির দোকানটা ঠিক থাকবে তো! ‘‘ছেলে বলে দিয়েছে, যেতে হতে পারে। কিন্তু দোকানটা ফেলে আমি যাব কী করে? ওর মায়ের হাতে তৈরি তো!’’ শহুরে বাতাস ভারী হচ্ছে ঠাঁই হারানোর দীর্ঘশ্বাসে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন