জখম অভিজিৎ সিংহ
রাতের কলকাতা দিয়ে ‘বাঁচাও বাঁচাও’ বলে ছুটে যাচ্ছেন এক যুবক। তাঁর পুড়ে যাওয়া হাত এবং পা থেকে খসে পড়ছে পোড়া চামড়া।
ধর্মতলার কাছে ওরিয়েন্ট সিনেমা হলের সামনে থেকে ছুটতে ছুটতে গণেশ অ্যাভিনিউ ও চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউয়ের মোড় পর্যন্ত ওই অবস্থায় পৌঁছতে অন্তত ১০ মিনিট লাগে তাঁর। ছুটে যাওয়ার সময়ে খুঁজতে থাকেন পুলিশকে। ফুরিয়ে আসতে থাকে দম। কিন্তু, কোথায় পুলিশ? নিয়নের তলায় শুধু মসৃণ পিচ রাস্তা পড়ে থাকে। কোথাও দেখা নেই নগরীর রক্ষকদের।
এক শরীর জ্বালা নিয়ে যে রাস্তা দিয়ে ছুট দিয়েছিলেন যুবক, সেই রাস্তা তো লালবাজারের আশপাশেই। অথচ কোথাও টহলদারি ভ্যান নেই। রাতের শহরে রাস্তার পাশের কিয়স্কেও তো পুলিশের থাকার কথা! কিন্তু প্রথমে বেন্টিঙ্ক স্ট্রিটের মোড় ও পরে চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউয়ের মোড়ের কিয়স্ক থেকেও কোনও পুলিশকর্মী এগিয়ে আসেননি তাঁকে সাহায্য করতে।
রবিবার, বড়দিনের রাত তখন প্রায় তিনটে। অর্ধদগ্ধ ওই যুবক অভিজিৎ সিংহের সামনে ওই মোড়ে এসে দাঁড়ায় একটি হলুদ ট্যাক্সি। তাঁর চালকই অভিজিৎকে তুলে নিয়ে পৌঁছে দেন মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে।
কোথায় গেল রাতপাহারার পুলিশ? বড়দিনের রাতেও রাস্তায় পুলিশ নেই? কলকাতা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার সুপ্রতিম সরকার এই প্রশ্নের কোনও জবাব দেননি। ফলে জানা যায়নি, রাজপথে অসহায় যুবকের সাহায্যে কেন এগিয়ে এল না পুলিশ। বিষয়টি শুনে সুপ্রতিমবাবু শুধু বলেন, ‘‘ঘটনাটি সম্পর্কে জানি না। খোঁজ নিয়ে দেখছি।’’
অভিজিৎ পাহারাদারের কাজ করছিলেন বন্ধ হয়ে যাওয়া ওরিয়েন্ট সিনেমা হলে একটি বেসরকারি সংস্থার অফিসে। রবিবার রাতে সেখানেই আগুন লেগে জখম হন তিনি। দমকল জানিয়েছে, ছ’টি ইঞ্জিন ঘটনাস্থলে পৌঁছে আগুন নিয়ন্ত্রণ করে। আগুনের খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে পুলিশও পৌঁছয়। কিন্তু, তার আগেই অভিজিৎবাবু যন্ত্রনায় ছটফট করতে করতে দৌড়তে শুরু করেন হাসপাতালের দিকে।
অভিজিৎ জানিয়েছেন, এ শহরের ফুটপাথে যাঁরা রাত কাটান, তাঁকে ওই অবস্থায় ছুটে যেতে দেখে, তাঁর চিৎকার শুনে তাঁদের অনেকেই কম্বলের ঢাকা সরিয়ে মুখ বার করেছিলেন। কিন্তু এগিয়ে আসেননি কেউই।
সোমবার হাসপাতালের বিছানায় শোভাবাজারের বাসিন্দা অভিজিৎবাবু জানান, ২৭ নম্বর বেন্টিঙ্ক স্ট্রিটের ওই বাড়িতে নিরাপত্তারক্ষীর কাজ করেন তিনি। সাততলা বাড়িটিতে এখন মাত্র তিনটি ঘরে অফিস রয়েছে। রবিবার রাতে বাড়ির নীচে চেয়ারে বসেছিলেন তিনি। আচমকাই উপর থেকে বিকট শব্দ শুনে চেয়ার থেকে লাফিয়ে ওঠেন তিনি। অন্ধকারে ঘাড় ঘুরিয়ে উপরে কী ঘটেছে তা দেখার চেষ্টা করেন। আর তখনই জ্বলন্ত প্লাইউডের একটি বড় অংশ উড়ে এসে পড়ে তাঁর গায়ে। ছিটকে মাটিতে পড়ে যান তিনি। তাঁর উপরে পড়ে জ্বলন্ত প্লাইউডের অংশ।
হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে অভিজিৎবাবু জানান, এতটাই বড় ও ভারী ছিল প্লাইউডের চাদর যে তিনি প্রথমে চেষ্টা করেও তা সরাতে পারেননি। জ্বলতে থাকা প্লাইউডের তলায় চাপা পড়ে সেই সময়ে পুড়ে যাওয়া ছাড়া তাঁর আর কোনও উপায় ছিল না। শুধু প্রাণভয়ে চিৎকার করে গিয়েছেন প্লাইউডের তলা থেকে। যে চিৎকার শুনে একটা হাতও এগিয়ে আসেনি তাঁকে তোলার জন্য।
তাঁর দু’হাত, ঊরু এবং পায়ের কিছুটা অংশ পুড়ে গিয়েছে। ক্ষতি হয়েছে মুখেরও। হাসপাতাল সূত্রের খবর, অভিজিতের দেহের ২৭ শতাংশ পুড়ে গিয়েছে। এই ক্ষত সেরে ওঠার সময়ে সংক্রমণের আশঙ্কা রয়েছে বলেও চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন।
এ দিন তিনি বলেন, ‘‘আমি মাটিতে পড়ে ছটফট করছিলাম। অন্যরা ছুটে এলেও চারতলার ওই ঘরে জল দিতেই ব্যস্ত হয়ে পড়েন তাঁরা। আমার দিকে কেউ ফিরেও তাকায়নি। বুঝতে পারি, যা করার আমাকেই করতে হবে। ওই ভাবে কতক্ষণ পড়েছিলাম বলতে পারব না। একটু পরে যখন বুঝতে পারি, কেউ সাহায্য করতে আসবে না, তখন অনেক কষ্টে মনের জোরে প্লাইউ়ড সরিয়ে নিজেই উঠে দাঁড়াই। তার পরে বাঁচাও বাঁচাও বলে চিৎকার করে গণেশ অ্যাভিনিউ ধরে মেডিক্যাল কলেজের দিকে দৌড়তে শুরু করি। বুঝতে পারছিলাম পোড়া চামড়া গা থেকে খসে পড়ছে।’’
চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউয়ে পৌঁছনোর পরে ওই ট্যাক্সিচালক অভিজিৎবাবুকে দেখে দাঁড়ান। অভিজিৎবাবু বলেন, ‘‘পোড়া-হাত মুখ দেখিয়ে শুধু হাসপাতাল কথাটা বলতে পেরেছিলাম। তিনিই দ্রুত ট্যাক্সিতে তুলে হাসপাতালে পৌঁছে দেন।’’ শুধু ওই ট্যাক্সিচালকের নামটাই জানা হয়নি, আক্ষেপ অভিজিৎবাবুর।
রাতের শহরে আবার হারিয়ে গিয়েছেন তিনি।