মনোজ খান্ডেলওয়াল
মাঝের আসনে মোবাইলে ব্যস্ত এসইউভি-র মালিক। চালক জানতেন, বাঙুর অ্যাভিনিউয়ের বাড়িতে তাঁকে পৌঁছে দিতে হবে। কিন্তু গিরিশ পার্ক মোড়ের কাছে গলিপথের মোড় ঘুরতেই এসইউভি ঘিরে ধরল পাঁচ জনের একটি দল। হাতে আগ্নেয়াস্ত্র! জোর করে গাড়িতে উঠে মালিক ও চালকের মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে তারা নির্দেশ দিল, ‘‘সোজা চালা। গাড়ি যেন না থামে!’’
বুধবার রাত সাড়ে ১০টা নাগাদ এ ভাবেই অপহৃত হয়ে গিয়েছিলেন মনোজ খান্ডেলওয়াল (৪৫) নামে এক পানমশলার ব্যবসায়ী। বৃহস্পতিবার ভোরে ঝাড়খণ্ড সীমানা লাগোয়া পশ্চিম বর্ধমানের সালানপুরে নাকা তল্লাশির সময়ে তাঁকে উদ্ধার করে পুলিশ। গ্রেফতার হয় সুনীল মাহাতো, বিবেক কুমার, শিবম কুমার, করণ কুমার এবং গলু কুমার নামে পাঁচ অপহরণকারী। সুনীল কলকাতার বাসিন্দা। বাকিরা ঝাড়খণ্ডের। তাদের কাছ থেকে দু’টি পাইপগান এবং একটি পিস্তল উদ্ধার হয়েছে। মিলেছে নয় রাউন্ড কার্তুজও।
পুলিশ জানায়, অপহরণের পরে গিরিশ পার্ক মোড় পেরিয়ে বিবেকানন্দ রোডের দিকে কিছু দূর এগোনোর পরে মনোজের গাড়িচালক যাদব কিশোরকে গাড়ি থামাতে বলে অপহরণকারীরা। আগে থেকে দাঁড় করানো অন্য একটি এসইউভি-তে জোর করে তোলা হয় মনোজ ও যাদবকে। মানিকতলা মোড়ের কাছে সিগন্যালে গতি সামান্য কম হতেই কোনও মতে গাড়ি থেকে লাফ দেন যাদব। তিনিই মানিকতলা মোড়ের কাছে কর্তব্যরত পুলিশকে বিষয়টি জানান। চালক পালিয়ে গেলেও মনোজকে নিয়েই অপহরণকারীরা রওনা দেয়।
আরও পড়ুন: স্টিয়ারিং ঘোরাতেই সন্দেহ হয় পুলিশের
মনোজের গাড়িচালককে প্রথমে আমহার্স্ট স্ট্রিট থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের পরে তাঁকে গিরিশ পার্ক থানায় পাঠানো হয়। খবর যায় বাঙুরে, মনোজের ফ্ল্যাটেও। রাতেই গিরিশ পার্ক থানায় মনোজের অপহরণের অভিযোগ দায়ের করেন তাঁর পরিবারের লোকজন। মনোজের মোবাইলের টাওয়ার লোকেশন ধরে খোঁজ শুরু করে লালবাজার।
আরও পড়ুন: ঘুম ভাঙতেই কৃষ্ণাঙ্গ যুবককে গুলি পুলিশের
পরদিন ভোর সাড়ে পাঁচটা নাগাদ বর্ধমান পুলিশের তরফে লালবাজারকে জানানো হয়, কলকাতার এক ব্যবসায়ীকে সালানপুরের কাছে আটকানো হয়েছে। জানানো হয়, ভোর ৪টে ১০ মিনিট নাগাদ সালানপুরের দেন্দুয়ায় নাকা তল্লাশির সময়ে কলকাতার নম্বর প্লেটওয়ালা গাড়িটি দাঁড় করান পুলিশকর্মীরা। তল্লাশি হবে শুনেই স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে গাড়ির চালক। তখন এক তৎপর সিভিক ভলান্টিয়ার দ্রুত গাড়ির চাবিটি (ইগনিশন কি) খুলে নিতে ধরা পড়ে যায় সে। দেখা যায়, মাঝের আসনে মুখে কাপড় ঢাকা অবস্থায় কাউকে বসিয়ে রাখা হয়েছে। কাপড় সরাতেই দেখা যায়, ওই ব্যক্তির মুখে সেলোটেপ লাগানো। চোখ-মুখে আতঙ্ক। তিনি ঘোরের মধ্যে রয়েছেন।
আসানসোল-দুর্গাপুর কমিশনারেটের এডিসিপি (পশ্চিম) অনমিত্র দাস জানিয়েছেন, ওই ব্যবসায়ী তাঁদের বলেছেন, অপহরণের পরে মারধর করার পাশাপাশি দু’বার ইঞ্জেকশন দেওয়া হয় তাঁকে। দীর্ঘ সময় তাঁর জ্ঞান ছিল না। মাঝে জ্ঞান ফিরলে ফের মারধর করা হয়। মনোজকে উদ্ধারের পরে স্থানীয় হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করানো হয়েছে। ধৃতদের সঙ্গে এ দিন মনোজকে আসানসোলের আদালতে তোলা হয়। আইনি প্রক্রিয়া মেনে কাল, শনিবার ধৃতদের ট্রানজিট রিমান্ডে কলকাতায় আনা হতে পারে। তাদের আনতে গিরিশ পার্ক থানার পাশাপাশি লালবাজারের গোয়েন্দা শাখার আধিকারিকেরাও সালানপুরে গিয়েছেন।
ওই ব্যবসায়ীকে এ ভাবে অপহরণের চেষ্টা কেন করা হল, তা তদন্তকারীদের কাছেও বৃহস্পতিবার রাত পর্যন্ত পরিষ্কার নয়।
অপহৃত ব্যবসায়ীও জানিয়েছেন, তাঁকে এর আগে কেউ কোনও রকম হুমকি দেয়নি। তবে পুলিশের প্রাথমিক অনুমান, মনোজকে ঝাড়খণ্ডে পাচারের ইচ্ছে ছিল অপহরণকারীদের। পানমশলার পাশাপাশি নির্মাণ ব্যবসার সঙ্গেও যুক্ত মনোজ। স্ত্রী, এক মেয়ে এবং এক ছেলেকে নিয়ে বাঙুরে একটি ফ্ল্যাটে থাকেন তিনি। সেই ফ্ল্যাটে এ দিন দুপুরে একাই ছিল তাঁর ১৭ বছরের মেয়ে রাধিকা খান্ডেলওয়াল। সে জানায়, বাবাকে আনতে দাদা আয়ুষ এবং মা বর্ধমান গিয়েছেন। রাধিকার কথায়, ‘‘বুধবার সকালে রোজের মতোই বেরিয়েছিলেন বাবা। আর ফেরেননি। পরে শুনলাম, বাবাকে কেউ তুলে নিয়ে গিয়েছে!’’
অঙ্কন: কুণাল বর্মণ