কবিতা রায়
যৌনপল্লি থেকে দুই নাবালিকাকে উদ্ধার করে এনে আশ্রয় দেওয়ার ২৪ ঘণ্টা না-পেরোতেই খুন হয়ে গেলেন ওই আশ্রয়স্থলেরই কেয়ারটেকার। আর তার পর থেকেই নিখোঁজ ওই দুই কিশোরী। ঘটনায় দিনভর চাঞ্চল্য ছড়িয়েছে সোনাগাছি এলাকায়। আর তদন্ত যত এগিয়েছে, ততই ঘনীভূত হয়েছে রহস্য।
পুলিশ জানিয়েছে, বুধবার সোনাগাছির ১২/৫ নীলমণি মিত্র স্ট্রিটের বাড়ি থেকে উদ্ধার হয়েছে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের দফতরের কেয়ারটেকার, বছর পঞ্চান্নর কবিতা রায়ের দেহ। তাঁর মাথা থেঁতলানো ছিল, গলায় গামছার ফাঁস। সারা শরীরে আঘাতের চিহ্ন। সংগঠনটি দীর্ঘদিন ধরে নারী ও শিশু পাচারের বিরুদ্ধে কাজ করছে। মাঝেমধ্যেই নাবালিকাদের উদ্ধার করে বাড়ি পৌঁছে দেন তাঁরা। নিখোঁজ হয়ে যাওয়া দুই নাবালিকাও এ ভাবেই উদ্ধার হয়েছিল।
কারা ওই দুই নাবালিকা?
সংগঠনের এক কর্মী জানিয়েছেন, সোমবার হাড়কাটা গলির যৌনপল্লিতে দুই কিশোরীকে ঘুরতে দেখেন সংগঠনের স্বেচ্ছাসেবীরা। জানা যায়, বনগাঁর গোপালগঞ্জ থেকে এসেছে তারা। বয়স ১৪-১৫ বছর। প্রশ্নের মুখে তারা জানায়, তারা স্বেচ্ছায় এখানে এসেছে ‘পেশা’ করবে বলে। ঘর ভাড়া নিতে চায়। নাবালিকা অবস্থায় এমন সম্ভব নয় বলে জানিয়ে দু’জনের কাউন্সেলিং করেন কর্মীরা। তার পরে তাদের আনা হয় সংগঠনের নীলমণি স্ট্রিটের দফতরে। ‘শর্ট শেল্টার’-এ কবিতাদেবীর তত্ত্বাবধানে রাখা হয় তাদের। মঙ্গলবার ভাইফোঁটা উপলক্ষে ছুটি ছিল দফতরে। দুই কিশোরীর সঙ্গে দিনভর একাই ছিলেন কবিতাদেবী। রাতেই ঘটে অঘটন।
কবিতাদেবীর খুনের সঙ্গে এই দুই নিখোঁজ কিশোরীর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ যোগ আছে কি না, সে বিষয়ে অন্ধকারে পুলিশ। কিন্তু তদন্তে এমন কিছু তথ্য মিলেছে, যাতে ঘটনার সঙ্গে বড় অপরাধ চক্রের যোগ থাকার আশঙ্কা উড়িয়ে দিচ্ছে না পুলিশ।
পুলিশের একটি সূত্রের খবর, সোশ্যাল মিডিয়ায় এক যুবকের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল ওই কিশোরীদের। তিনি নিজেকে কাশ্মীরের বাসিন্দা বলে পরিচয় দিয়েছিলেন। এক কিশোরীকে বিয়ে করার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিলেন। ওই যুবকের কথাতেই কলকাতা এসেছিল তারা। তাদের পরিকল্পনা ছিল, ওই যুবকের সঙ্গে গুজরাত চলে যাওয়ার। সেই মতো সোমবার সন্ধেয় ট্রেনে করে বনগাঁ থেকে শিয়ালদহ এসে পৌঁছয় তারা। কিন্তু তার পরে হাড়কাটা গলির যৌনপল্লিতে তারা স্বেচ্ছায় গিয়েছিল, নাকি কারও প্ররোচনা ছিল, সে বিষয়ে ধন্দে তদন্তকারীরা। ওই যুবক কে, কোথায় আছেন— সে বিষয়েও কোনও সূত্র মেলেনি। তবে পুরো ঘটনাটির পিছনে বড় পাচার-চক্রের হাত রয়েছে বলেই আশঙ্কা তদন্তকারীদের।
পুলিশ জানায়, বাড়ির তিনতলায় খুন হন কবিতাদেবী। সেখানে যাওয়ার মোট তিনটি দরজারই তালা খোলা ছিল, ভাঙা নয়। পুলিশের অনুমান, আততায়ী সম্ভবত চেনা, যাঁকে দরজা খুলে দেন কবিতাদেবী নিজেই। এ ছাড়া বাড়িতে উপস্থিত দুই কিশোরীর হাত থাকার সম্ভাবনা তো আছেই।
সংগঠনের লিয়াজঁ অফিসার মহাশ্বেতা মুখোপাধ্যায় জানিয়েছেন, কবিতাদেবী নিজে এক জন যৌনকর্মী ছিলেন। ১৯৯২ সালে এই সংগঠনের সাহায্যেই মূলস্রোতে ফেরেন। সংগঠনের প্রেসিডেন্টও হন কয়েক বছরের জন্য। তার পর ওই দফতরের কেয়ারটেকারের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। তাঁর বাড়ি বা পরিবার সম্পর্কেও তেমন তথ্য নেই সংগঠনের কাছে।
ঘটনাস্থলে পুলিশি তদন্ত। —নিজস্ব চিত্র।
সংগঠন সূত্রের খবর, সোমবার রাতে দুই কিশোরীকে উদ্ধার করার পরেই তাদের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। কিন্তু মঙ্গলবার ভাইফোঁটার জন্য দফতর বন্ধ থাকায় পুলিশ ও সিডব্লিউসি-র প্রক্রিয়া মিটিয়ে তাদের ফেরানো যায়নি। পরিবারকে বলা হয়, বুধবার তাদের নিয়ে যেতে। সেই মতো এ দিন সকালে এসে পৌঁছন তাঁরা। শোনেন, সংগঠনের কেয়ারটেকার খুন হয়েছে। মেয়েরা নিখোঁজ।
সংস্থার মেন্টর ভারতী দে জানিয়েছেন, বাড়িটির সব ক’টি গেটের এবং ঘরের চাবি কবিতাদেবী ছাড়া আর কারও কাছে ছিল না। প্রতিদিন ভোরে তিনি নিজেই দরজা খুলতেন। দশটা থেকে আসতে শুরু করতেন সংগঠনের কর্মীরা। মঙ্গলবার দফতর বন্ধ থাকায় কেউ আসেননি, কিশোরী দু’টিকে নিয়ে দিনভর একাই ছিলেন কবিতাদেবী। বুধবার সকালে আসতে শুরু করেন কর্মীরা। সদর দরজা ভেজানো ছিল তখন।
তাপসী অধিকারী নামে এক কর্মী প্রথম তিনতলায় কবিতাদেবীর ঘরে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখেন তাঁকে। পাশেই রক্তাক্ত শিল-নোড়া।
যে বাড়িতে কবিতাদেবী খুন হয়েছেন, ঠিক উল্টো দিকের বাড়িতেই থাকেন হেমন্ত বসু। জানালেন, মঙ্গলবার সারা দিন দেখেননি কবিতাদেবীকে। তিনতলার বারান্দার দরজাটা রাত এগারোটা নাগাদ বন্ধ করতেন তিনি, কাল সেটাও বন্ধ হয়নি। তবে কোনও অস্বাভাবিক শব্দ শোনা যায়নি বলেই দাবি তাঁর।
খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে চলে আসেন ১৮ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর সুনন্দা সরকার। বললেন, ‘‘এত বছর ধরে কাজ করছে সংগঠনটি। কখনও এ রকম ঘটনা ঘটেনি। ভীষণ উদ্বিগ্ন লাগছে।’’ পুলিশ জানিয়েছে, ঘটনাস্থল থেকে সব নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। নিখোঁজ নাবালিকাদের খোঁজ পাওয়া গেলে অনেকটাই জট কাটবে বলে আশা তদন্তকারীদের।