শশাঙ্ক মণ্ডল
এই পৃথিবীর যেখানেই যাই না কেন, এই পাড়া পেরিয়েই যেতে হয়। আবার যত দূরেই যাই, পায়ে-পায়ে জড়িয়ে থাকে আমার পাড়া। কী নিবিড় সম্পর্ক বারবার পিছু ডাকে। পিকলুর দোকানে ভাঁড়ের চা, মাঠে প্রথম ধূমপানের স্মৃতি, পুজোর ঢাক— আরও কত কী! পাড়া মানেই যেন এক আবাল্য প্রেম।
আমার পাড়াটা কিন্তু দো-নামা। আসলে এ পারে বোসপাড়া, আর ও পারে নারকেলবাগান— মধ্যে রয়েছে এক কালো পিচঢালা বাইশ ফুটের ব্যবধান। কিন্তু ওই পথই আমাদের সংযোগ সেতু, তাই আমরা দুই পাড়া মনে-প্রাণে একসঙ্গেই থাকি।
গত পঞ্চাশ বছরে একটু একটু করে বেড়েছে জনবসতি। তৈরি হয়েছে নতুন বাড়ি আর বহুতল। নব্বইয়ের দশকে টালিগঞ্জ প্রর্যন্ত মেট্রোরেল চলাচল শুরুর পর থেকেই বদলাতে থাকে এলাকার ছবিটা। এই পরিবর্তনটা আরও প্রকট হয়েছে নিউ গড়িয়া পর্যন্ত মেট্রোরেল সম্প্রসারণের পরে। যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হলেও বেড়েছে মানুষের সংখ্যা। সেই সঙ্গে এলাকায় জমি-বাড়ির দাম আজ আকাশ ছোঁয়া।
মসৃণ রাস্তাঘাট, সোডিয়াম ভেপারের আলোর মতো নাগরিক পরিষেবা আগের চেয়ে ভাল হয়েছে। উন্নত হয়েছে যোগাযোগ ব্যবস্থাও। পাশাপাশি, বদলেছে এ অঞ্চলের আকাশরেখাও। এখন চাঁদ এসে দাঁড়ায় বহুতল বাড়ির ছাদে— উঁকি দেওয়ার জন্য নারকেল গাছের সংখ্যাও এখন হাতে গোনা। অতীতের পেয়ারাবাগান হয়তো হয়ে গিয়েছে কোনও পার্ক। দু’-একটি মাঠ থাকলেও খেলার লোক কই? খেলা তো এখন শুধু কৈশোরের খুশি নয়, অনেকটাই প্রাতিষ্ঠানিক। অবশ্য ছুটির দিনে কখনও-সখনও কিছু কচিকাঁচাকে খেলতে দেখা যায়।
মাঝবয়সিদের আড্ডা এক-আধটা আছে বটে, তা-ও নিয়মিত নয়। বৃদ্ধেরা কাছাকাছি পার্কে যান সকাল-সন্ধ্যায়। আড্ডার সেই আকর্ষণ অনেকটাই কমেছে। এলাকায় রয়েছে বেশ কয়েকটি ক্লাব। কোথাও কোথাও পাড়ার মহিলারা নিজেদের পড়াশোনা, ঘরগেরস্থালি বা চাকরি সামলিয়ে সংস্কৃতি চর্চা করেন। রয়েছে পূর্ণিমা সম্মিলনী। দীর্ঘ ৬৪ বছর ধরে মাসে এক বার জ্ঞান-বিজ্ঞান শিক্ষা বিষয়ে সেমিনার হয়ে থাকে। তা ছাড়া রয়েছে বৃহত্তর গড়িয়া অঞ্চলের মানুষের অত্যন্ত প্রিয় এক বইমেলা। এ বছর সে মেলা সাত বছর পেরিয়ে আটে পা রাখল। আমাদের আর এক গর্ব ‘আজাদ হিন্দ পাঠাগার’। আগের চেয়ে পাঠক সংখ্যা কমেছে ঠিকই, তবু এখনও নিয়মিত হাজির হন কিছু প্রবীণ মানুষ। হাটবাজারের আধুনিকীকরণ, আর ঝকঝকে শপিং মলের পাশাপাশি এক চমৎকার সহাবস্থানে রয়েছি আমরা।
অতীতে এখানে বাড়ির সংখ্যা ছিল নগণ্য। সব বাড়িতেই ছিলেন কাকা-জ্যাঠা-মাসি-পিসি— মানে পাড়াজোড়া অভিভাবকত্ব। তেমনই সব বাড়িতেই ছিল ভাই-বোন-বন্ধু। অবাধ আমন্ত্রণ থাকত মকর সংক্রান্তির পিঠেপুলি বা লক্ষ্মীপুজোর নাড়ুর। তখন টালিনালা দিয়ে মাটির হাঁড়ি-কলসি নিয়ে ভেসে আসত নৌকা হাটে বিক্রির জন্য। আর সন্ধ্যাবেলায় শাঁখের শব্দের সঙ্গে সঙ্গত করত শেয়ালের ডাক।
এ বাড়ির আম-কাঁঠালে, ও বাড়ির বড়ি-আচারে কার্যত সর্বজনীন অধিকার ছিল। সবুজ শুধু চারপাশেই নয়, ছিল সকলের মনেও। সকলেই যেন একসঙ্গে গড়ে উঠতাম। সাঁতার বা সাইক্লিং শেখার ধুম, ফুটবল— সব কিছুতেই ছিল এক অশিক্ষিত অথচ আনন্দময় পটুত্ব। এক-আধ জন ‘নতুন-দা’ও থাকতেন কী পড়াশোনার, কী খেলাধুলোর স্বঘোষিত কোচ। এখনও তারা আছেন।
এই অঞ্চলটি বেশ প্রাচীন। কাছেই টালিনালা। রয়েছে বেশ কিছু প্রাচীনত্বের চিহ্ন। এখানেই আছে বাসনা কালীবাড়ি। কাছেই রয়েছে দু’টি আটচালা মন্দির। সম্প্রতি তার সংস্কার হয়েছে। কাছাকাছি হয় নবদুর্গা এবং পঞ্চদুর্গার পুজো। পুজোর দিনগুলোয় অন্তহীন জনস্রোত। আর আছে ছোট ছোট কিছু পাড়ার পুজো।
এক সময়ে এলাকার বাসিন্দা ছিলেন জাহ্ণবীকুমার চক্রবর্তী, ক্ষেমেশচন্দ্র দে-র মতো খ্যাতনামা অধ্যাপক। স্বাধীনতাসংগ্রামী শৈলেশকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় অথবা গণপতি পাঠকের মতো শিল্পীরাও থাকতেন কাছাকাছি। ছিলেন মঞ্জু দে, অভি ভট্টাচার্যর মতো অভিনেতা। শ্রীজাতর বড় হওয়া এখানেই।
অনেক উন্নতি, পরিবর্তন হয়েছে ঠিকই, তবু হঠাৎ যখন কোনও প্রতিবেশীর বাড়িতে সাদা কাপড়ের প্যান্ডেল দেখে বুঝি কোনও নিকটজন আর নেই, তখন মনে হয় কাছে থাকলেও নিকটজন আর সত্যি নিকট নেই! সন্ধ্যায় মাঝেমধ্যে ফ্ল্যাটবাড়ির বেসমেন্টে বিষণ্ণ মুখে পায়চারি করেন কিছু পরিচিত মুখ।
অতীতের অনেক কিছুই আজ নেই, তবে দয়াল জ্যেঠু কিংবা দীনুকাকাদের নাম স্মৃতির হাওয়ায় ভেসে বেড়ায়। শুধু বলব, আমাদের পাড়ার বাড়িগুলো এখনও পরিপূর্ণ অপরিচয়ের নোনাজলে ঘেরা এক-একটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপ হয়ে ওঠেনি। আনন্দে-বেদনায় এখনও আমরা নিঃসঙ্গ নই, বিপদ-আপদে, উৎসবে এখনও তরুণেরা হাত বাড়িয়ে দেন। মেলামেশার ইচ্ছেটা এ অঞ্চলে এখনও ব্যস্ততার ভ্রুকুটিকে উপেক্ষা করে অনেকাংশে বেঁচে আছে। সেই ইচ্ছেটা দীর্ঘায়ু হোক।
লেখক অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক