শুভাশিস ভট্টাচার্য
সঙ্কীর্ণ গলি। দু’ধারে গায়ে গায়ে পুরনো বাড়ি। হাঁটতে হাঁটতে ক্রমেই ক্ষীণ হয়ে আসে রাজপথের নানা আওয়াজ। খোলা জানলা দিয়ে কানে আসে রেডিওর গমগমে সুর। কখনও বা পাড়া-পড়শির আলাপচারিতা। এমনই বর্ণময় আমার পাড়া অভয় হালদার লেনে। কোনও ঝাঁ চকচকে অভিজাত পাড়া নয়। আনাচে কানাচে মিশে আছে বনেদিয়ানা।
নির্মলচন্দ্র স্ট্রিট থেকে শুরু করে মদন বড়াল লেনের গা ঘেঁষে শুরু হওয়া অভয় হালদার লেন গিয়ে মিশেছে মলঙ্গা লেনে। অন্য দিকে, মদন বড়াল লেন গিয়ে মিশেছে শ্রীনাথ দাস লেনে। ডান দিকে লাল বিহারী ঠাকুর লেন। এ সব নিয়েই আমার পাড়ার চৌহদ্দি।
বড় রাস্তা থেকে পাড়াটা একটু ভিতরে হওয়ায় পরিবেশ শান্ত, নির্ঝঞ্ঝাট। প্রায় একশো বছরেরও বেশি এ পাড়ায় আমাদের বসবাস। যৌথ পরিবার বলে একই পাড়ার শাখা-প্রশাখার মধ্যে আমাদের একাধিক বাড়ি ছিল। তাই এ বাড়ি-সে বাড়ি আর পাড়ার শাখা-প্রশাখা নিয়েই গড়ে উঠেছিল আমার স্বতন্ত্র জগৎ।
সময়ের সঙ্গে পাড়ার বাইরের চেহারা খুব একটা না বদলালেও বদলেছে অন্তরের রূপ। এলাকার সার্বিক উন্নয়ন হয়েছে। আগে যত্রতত্র আবর্জনা পড়ে থাকলেও এখন বদলেছে। নিয়মিত রাস্তা পরিষ্কার হওয়ায় এখন পাড়া এবং সংলগ্ন এলাকা পরিচ্ছন্ন থাকছে। রয়েছে পর্যাপ্ত আলো এবং জলের ব্যবস্থাও।
এ পাড়ায় আজও বেশির ভাগই বাড়ি। ভাবতে ভাল লাগে এখনও প্রবেশ করেনি ফ্ল্যাট কালচার। তবে প্রজন্মের ব্যবধানে মানুষে মানুষে যোগাযোগ কমেছে। আগে প্রতিবেশী পরিবারগুলি ছিল একে অপরের পরিপূরক। ঠিক আত্মীয়ের মতো। পুরনো প্রতিবেশীদের সঙ্গে যোগাযোগ আছে ঠিকই, তবে কমেছে অন্তরের টান। কমেছে একে অপরের বাড়িতে যাতায়াত। তবু সুখ-দুঃখে তাঁরা পাশে থাকেন।
আগে পাড়া মানে ছিল বৃহৎ একান্নবর্তী পরিবার। নিজের পরিবারের মানুষ ছাড়াও বয়সে বড় পড়শিরাও শাসন করতেন, আবার ভালও বাসতেন। নিজের কাকা, জ্যাঠার থেকে তাঁরাও তো কোনও অংশে কম আত্মীয় ছিলেন না। মনে পড়ে, ছোটবেলায় খেলতে গিয়ে সন্ধ্যা হয়ে গেলে পাড়ার অভিভাবকেরা নির্দ্বিধায় বলতেন, ‘‘যা তাড়াতাড়ি বাড়ি গিয়ে পড়তে বস।’’ এমনটা আজকাল ভাবাই যায় না। পরিবর্তন এসেছে মানুষের চিন্তাধারায়।
বেশ কিছু বাড়ির হাতবদল হয়েছে। এসেছে অবাঙালিরা। ফলে পাড়ায় প্রবেশ করেছে প্রদেশিক প্রভাব। ধীরে ধীরে বদলেছে পাড়ার পরিচিত পরিবেশ। অত্যধিক জমি কিংবা বাড়ির দামের জন্য এ অঞ্চলে নতুন যাঁরা আসছেন, তাঁদের বেশির ভাগই অবাঙালি।
ছেলেবেলায় বিকেল মানেই ছিল দেদার খেলা। খেলাধুলোর অন্যতম স্থান ছিল লালবিহারী পার্ক। বদলেছে পার্কের চেহারাও। উঁচু গ্রিলে ঘেরা পার্কটি সব সময়ে পরিচ্ছন্ন থাকে। বসেছে জোরালো আলো। পাশেই হয়েছে প্রবীণদের বসার জায়গা। তবে খেলতে আসা ছোটদের সংখ্যা দিনে দিনে কমছে। এখন শুধু ছুটির দিনে কিছু ছেলেদের খেলতে দেখা যায়। কয়েক বছর আগেও আশেপাশের বাড়ির খুদেরা নিয়মিত মাঠে খেলতে আসত। এক-এক সময় ভেবে আক্ষেপ হয় যে, পাড়ায় দু’টি মাঠ থাকলেও খেলতে দেখা যায় না ছোটদের।
এখন ছোটদের বিকেল-সন্ধ্যাটা কোচিং-এর জালে আটকে রয়েছে। পাশাপাশি কমেছে মধ্যবিত্ত বাঙালি পরিবারে শরীরচর্চার অভ্যাসও। এখন বিক্ষিপ্ত ভাবে
কিছু পরিবারে চোখে পড়ে জিমে যাওয়ার চল।
আমাদের পাড়ার রাস্তাটা বেশ সঙ্কীর্ণ। গাড়ি ঘোরানোর উপযুক্ত জায়গা না থাকায় সাধারণত কোনও গাড়ি ঢোকে না এখানে। শুধু বাইক আর টানা রিকশা যাতায়াত করে।
কমেছে আড্ডার পরিবেশও। নিরাপত্তার কারণেই আড্ডা দেওয়ার মতো রকগুলিকে গ্রিল দিয়ে ঘিরে ফেলা হয়েছে। এখন ছুটির দিনে দেখা যায় বিক্ষিপ্ত আড্ডা। কখনও বাড়ির সামনে, কখনও বা পাড়ার মোড়ে। দেখতে দেখতে রকগুলো হারিয়ে গেল। হারাল আড্ডার আমেজটা। আগে পাড়ায় হতো অনুষ্ঠান, নাটক, যাত্রা। সে সব ইতিহাস। হারিয়ে গিয়েছে কালীপুজোর সময়ে তুবড়ি প্রতিযোগিতাও।
পাড়ার মুখে নির্মলচন্দ্র স্ট্রিটে আজও দাঁড়িয়ে চন্দ্রদের বহু স্মৃতি বিজড়িত বাড়িটি। এক কালে এখানেই এসেছেন বহু বিখ্যাত মানুষ। আজও দুর্গাপুজোর সময়ে এখানে প্রতিমা দেখতে ভিড় করেন কত উৎসুক মানুষ।
পাড়ার যুব সম্প্রদায় এখন উন্নয়নের ব্যাপারে বেশ উৎসাহী। প্রয়োজনে তাঁদের পাওয়া যায়। তাঁদেরই উদ্যোগে হয় ছোটদের আঁকার প্রতিযোগিতা আর রক্তদান শিবির।
কাছাকাছির মধ্যে রয়েছে বৌবাজার আর কলেজ স্ট্রিট বাজার। নির্মলচন্দ্র স্ট্রিটের এক ধারে ফুটপাথেই সব্জি-মাছ নিয়ে বসেন বেশ কিছু দোকানি। কাছাকাছি সব মিললেও বেড়েছে ফুটপাথে হাঁটাচলার সমস্যা।
উল্লেখযোগ্য, এ পাড়ার ভৌগোলিক অবস্থান আজও ধরে রেখেছে আমাদের সকলকে। কখনও আলাদা হওয়ার কথা ভাবেননি। এক দিকে শিকড়ের টান অন্য দিকে নিরাপত্তা বোধ। এটাই তো এ পাড়ার সবচয়ে বড় পাওনা!
লেখক ব্যবসায়ী