সিএমআরআই

থমথমে এলাকা, আতঙ্কের রেশ হাসপাতালেও

মূল ফটক সম্পূর্ণ বন্ধ। পিছন দিয়ে বেশ খানিকটা ঘুরে অন্য গেট দিয়ে ঢুকতে হচ্ছে হাসপাতালে। চিকিৎসা পরিষেবা স্বাভাবিক করার আপ্রাণ চেষ্টা চললেও ২৪ ঘণ্টা আগেই ঘটে যাওয়া তাণ্ডব ঘিরে আতঙ্কের রেশ দিব্যি টের পাওয়া গেল।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ ০০:২০
Share:

মূল ফটকে তালা। বৃহস্পতিবার, সিএমআরআই-এর সামনে। — স্বাতী চক্রবর্তী

মূল ফটক সম্পূর্ণ বন্ধ। পিছন দিয়ে বেশ খানিকটা ঘুরে অন্য গেট দিয়ে ঢুকতে হচ্ছে হাসপাতালে। চিকিৎসা পরিষেবা স্বাভাবিক করার আপ্রাণ চেষ্টা চললেও ২৪ ঘণ্টা আগেই ঘটে যাওয়া তাণ্ডব ঘিরে আতঙ্কের রেশ দিব্যি টের পাওয়া গেল। ডাক্তার, চিকিৎসাকর্মী, নিরাপত্তারক্ষী, রোগীর আত্মীয়দের চোখমুখ বৃহস্পতিবারও থমথমে।

Advertisement

হাসপাতালের আইসিইউ বিভাগের পাশে, চারতলার সিঁড়িতে বসেছিলেন হাওড়া শিবপুরের বাসিন্দা শ্রীমতী ঘোষ। হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত স্বামীকে ভর্তি করেছেন ঘণ্টা তিনেক আগে, এখনও আসেননি চিকিৎসক। আইসিইউ-এর এক চিকিৎসাকর্মী বললেন, ‘‘কালকের ঘটনার পরে অনেক কর্মীই আসেননি আজ। ডবল শিফ্‌ট খাটতে হচ্ছে।’’ রক্ষীরা সিঁটিয়ে রয়েছেন।

চিকিৎসা পরিষেবা অবশ্য স্বাভাবিক ভাবেই চলছে বলে দাবি করলেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। তবে তা যে আদতে ‘স্বাভাবিক’ নয়, তা বোঝা যায় পুলিশি নিরাপত্তার বহর দেখলেই। নিরাপত্তার আবহেই চলছে চিকিৎসা। এ দিন হাসপাতালের সিইও শান্তনু চট্টোপাধ্যায়ও বলেন, ‘‘কাল রাত থেকেই রোগী ভর্তি শুরু করেছি আমরা। সব কিছুই স্বাভাবিক ভাবে চলছে। তবে সব জায়গাতেই পুলিশি নিরাপত্তা রয়েছে।’’

Advertisement

ভাঙচুরের ঘটনায় এ দিন সকালে তিন জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। রাকেশ ধনুক, জিয়াউদ্দিন শেখ ও শেখ সোনি নামের তিন যুবককে ১৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত পুলিশি হেফাজত দিয়েছে আলিপুর আদালত। প্রশ্ন উঠেছে, ঘটনার সিসিটিভি ফুটেজে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে হামলাকারীদের মুখ। অথচ চব্বিশ ঘণ্টার বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও গ্রেফতারের সংখ্যা মাত্র তিন কেন? পুলিশের যুক্তি, তদন্ত চলছে। দশ জন হামলাকারীকে চিহ্নিত করা হয়েছে। বেশির ভাগ অভিযুক্তই পলাতক। তাঁদের খোঁজ চলছে।

অন্য দিকে ক্ষোভে, আতঙ্কে এখনও থমথম করছে একবালপুরের ভূকৈলাস রোডে বাঘকুটি মোড় তল্লাট। হাসপাতাল ভাঙচুরের ঘটনায় শুরু হয়েছে পুলিশি ধরপাকড়। গত কাল প্রায় সারা রাত ঘরে ঘরে ঢুকে চলেছে তল্লাশি। গ্রেফতার করা হয়েছে তিন জনকে। তার পরে এ দিন সকাল থেকেই এলাকা কার্যত পুরুষ-শূন্য। সকলেই পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। থমথমে পাড়ায় একমাত্র ভিড় মহম্মদ কামালের ছোট্ট ঘরটায়। তাঁর কিশোরী কন্যা সায়েকার মৃত্যু ঘিরেই তোলপাড়ে জড়িয়ে পড়েছেন পাড়া-প্রতিবেশীরা।

পরশু রাত থেকে এক ফোঁটা জলও খাওয়ানো যায়নি সায়েকার মা সুলতানা বেগমকে। কথাও বলছেন না। শুকনো চোখে চেয়ে রয়েছেন মহম্মদ কামাল। আত্মীয়স্বজন-প্রতিবেশীদের কান্না ছাপিয়ে বারবার উঠে আসছে একটাই দাবি, ‘‘অভিযুক্ত চিকিৎসকের শাস্তি চাই।’’ মৃত সায়েকার আত্মীয় মৈজাবিন বেগম বলছিলেন, ‘‘ক’দিন পরেই পরীক্ষা ছিল মেয়েটার। সেই জন্যই হাসপাতাল পাঠানো তাড়াহুড়ো করে। যদি জানতাম, ফিরবে না...।’’ সায়েকার মামি মুসাদাত পারভিনের অভিযোগ, এখনও পর্যন্ত সায়েকার একটি রিপোর্টও ফেরত দেয়নি হাসপাতাল। ‘‘মেয়েটার কী হয়েছিল, তা-ও জানতে পারলাম না।’’

এ দিন বিকেলে সাংবাদিক বৈঠক করে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ দাবি করেন, সায়েকাকে মৃতপ্রায় অবস্থাতেই আনা হয়েছিল হাসপাতালে। মানবিকতার খাতিরেই তাকে ভর্তি নেওয়া হয়, চিকিৎসাও শুরু হয়। কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি। অথচ সায়েকার পরিবারের অভিযোগ, তারা হাসপাতালে যাওয়া মাত্র দেড় লক্ষ টাকা দাবি করা হয়। সেই টাকা জোগাড় করতে গিয়েই দেরি হয়ে যায় তাঁদের। এ বিষয়ে প্রশ্ন করলে জবাব দিতে রাজি হননি হাসপাতালের চিফ অপারেটিং অফিসার শান্তনু চট্টোপাধ্যায়। জানান, বিষয়টি খতিয়ে দেখার জন্য হাসপাতালে অভ্যন্তরীণ কমিটি তৈরি করা হয়েছে।

আরও পড়ুন:

হুইলচেয়ারে শিক্ষক! মানবোই না, ‘দেখে নেওয়া হবে’ প্রধান শিক্ষিকাকে

তিনি এ দিন বারবার ভাঙচুরের নিন্দা করে একটাই কথা বলেন, ‘‘হাসপাতালের তরফে কোনও রকম গাফিলতি ছিল না। সব মৃত্যুর দায় চিকিৎসকদের নয়।’’ গাফিলতি যদি না-ই থাকে, তা হলে হাসপাতালের কমিটি কীসের তদন্ত করবে? কেনই বা সায়েকার কোনও রিপোর্ট রোগিণীর পরিবার পেল না? এই সব প্রশ্নের অবশ্য উত্তর মেলেনি।

বরং হাসপাতালের একটি সূত্রের দাবি, বুধবারের তাণ্ডবের পিছনে রয়েছে স্থানীয় গুন্ডাদের দাদাগিরি। অভিযোগ, মহম্মদ শাকিল নামের এক যুবক দীর্ঘ দিন ধরে ‘হুজ্জতি’ চালাচ্ছেন হাসপাতালে। তাঁর বিরুদ্ধে থানায় একাধিক অভিযোগ করা হয়েছে বলেও দাবি হাসপাতালের। মহম্মদ শাকিল জানান, আপৎকালীন পরিস্থিতিতে এলাকার স্থানীয় গরিব মানুষদের প্রায়ই দ্বারস্থ হতে হয় সিএমআরআই-এর। আর চিকিৎসা শুরুর আগেই সেখানে যে বিপুল অঙ্কের বিল ধরানো হয়, তা দেওয়ার সামর্থ্য থাকে না অনেকেরই। সে জন্যই তিনি একাধিক বার হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে বহু স্থানীয় মানুষের হয়ে অনুরোধ জানিয়েছেন বিলের অঙ্ক কম করতে। তাঁর কথায়, ‘‘মানুষের প্রয়োজনে বহু বারই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে মুখোমুখি কথা বলেছি। অনুরোধ করেছি টাকার অঙ্ক কমাতে। কখনওই খারাপ ব্যবহার করিনি।’’

এলাকায় ঘুরে জানা গেল, পাড়ার মেয়ের এমন অকালমৃত্যু মেনে নিতে না পেরে অনেকেই খেপে গিয়েছিলেন সে দিন। সেই সঙ্গে জমা ছিল চড়া মূল্যের বিনিময়ে পর্যাপ্ত পরিষেবা না মেলার রাগ, বারবার অমানবিকতার মুখোমুখি হওয়ার ক্ষোভ। তাই এমন অপ্রীতিকর ভাঙচুর ঘটে গিয়েছে। কোনও পরিকল্পনা করে নয়। সায়েকার বাবা মহম্মদ কামাল বলেন, ‘‘সকালে ওরা কিছুতেই বলতে চাইল না, আমার মেয়েটা কী করে মারা গেল। তখন রাগের মাথায় আমরা বলেছিলাম, ‘চাই না দেহ।’ ওরা বলল, ‘দেহ না নিলে রাস্তায় ফেলে দেব।’ তখন সকলেই মারমুখী হয়ে ওঠে।’’ পরিবারের আক্ষেপ, ‘‘এত বড় একটা ঘটনা, আমরা হাসপাতালের বিরুদ্ধে এফআইআর করলাম। সুবিচার তো দূরের কথা, সমবেদনা জানাতেও এলেন না কোনও রাজনৈতিক নেতা।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন