কমিটিই সার, কাজ শূন্য, আগুনের পর আগুন, সুপারিশের পর সুপারিশ, তবু টনক নড়ে না শহরের

ঘটনা ঘটে। কমিটি হয়। কিন্তু কাজের কাজ কার্যত কিছুই হয় না। হুঁশ ফেরে না শহরের আমজনতা বা প্রশাসনের। বড়বাজারের আমড়াতলা লেনের অগ্নিকাণ্ড ফের সেটাই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল।

Advertisement

মেহবুব কাদের চৌধুরী

শেষ আপডেট: ০১ মার্চ ২০১৭ ০২:১৯
Share:

শূন্যদৃষ্টি: চোখের সামনে সব শেষ। মঙ্গলবার। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক

ঘটনা ঘটে। কমিটি হয়। কিন্তু কাজের কাজ কার্যত কিছুই হয় না। হুঁশ ফেরে না শহরের আমজনতা বা প্রশাসনের। বড়বাজারের আমড়াতলা লেনের অগ্নিকাণ্ড ফের সেটাই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল।

Advertisement

২০০৮ সালে নন্দরাম মার্কেটের আগুন লাগার ঘটনা থেকে শুরু করলে গোটা দশক জুড়ে এ শহরের ইতিহাসের স্মরণীয় কিছু অগ্নিকাণ্ড ঘটতে দেখেছে কলকাতা। প্রতিটি বিপর্যয়ের পরেই পুলিশ-প্রশাসন নড়েচড়ে বসেছে। পুরসভা-দমকল-পুলিশ-পূর্ত দফতর-সিইএসসি কর্তাদের নিয়ে কমিটি গড়া হয়েছে। ঘটা করে শহরের বিভিন্ন এলাকার ‘জতুগৃহ’গুলি বাছাই করে রোগের লক্ষণ চিহ্নিত করতে অভিযানে বেরিয়েছেন তাঁরা। প্রতিটি কমিটির তরফেই কিছু না-কিছু সুপারিশ করা হয়েছে। বাস্তবে অবশ্য তা কার্যকর করার নামগন্ধ কেউ করেনি।

নন্দরাম মার্কেটের দু’বছরের মধ্যে ঘটে পার্ক স্ট্রিটের স্টিফেন কোর্টের অগ্নিকাণ্ড। তাতে দিনেদুপুরে ৪৩ জন প্রাণ হারান। এ রাজ্যে বাম জমানার শেষে রাজনৈতিক পালাবদল ঘটলেও আগুন নেভানোর ব্যবস্থায় গাফিলতির জেরে বিপর্যয়ের পরম্পরা অপরিবর্তিত থেকেছে। ২০১১-র শেষে দক্ষিণ কলকাতার অভিজাত আমরি হাসপাতালে রাতের অন্ধকারে আগুনে পুড়ে ও বিষাক্ত ধোঁয়ায় দম আটকে ৯৩ জন মারা গিয়েছিলেন। ২০১৩ সালে সূর্য সেন স্ট্রিট বাজারের আগুনও ১৯টি প্রাণ কেড়ে নেয়। সেই তুলনায় বড়বাজারে এ দিনের অগ্নিকাণ্ড যৎসামান্য। এ ক্ষেত্রেও আর একটু হলেই বড় বিপদ ঘটতে পারত শহরের দমকল ও পুলিশকর্তারা।

Advertisement

এক দমকলকর্তার কথায়, ‘‘সচরাচর বড়বাজার বা পুরনো কলকাতার ওই সব এলাকায় কোথাও আগুন লাগলে যে লক্ষণগুলি দেখা যায়, এখানেও সেটাই স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।’’ যেমন, আমড়াতলা লেনের তিনতলা বাড়িটির সিঁড়িগুলি কাঠের। তার উপরে সেই সিঁড়ি জুড়ে নানা সরঞ্জাম (বেশ কিছু দাহ্য পদার্থ-সহ) ডাঁই করে রাখা।

পুরনো বাড়িগুলির বেশির ভাগেই জলের সংস্থান বা আগুন নেভানোর আধুনিক বন্দোবস্ত কিছু নেই। সে সবের বন্দোবস্ত করা অনেক ক্ষেত্রে সম্ভবও নয়। নজরদারি কমিটির তরফে তাই অন্তত কিছু সাধারণ সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছিল। এর মধ্যে সিঁড়ি-বারান্দা সাফসুতরো রাখা, ঢোকা-বেরোনোর একাধিক দরজা খোলা রাখা কিংবা বিদ্যুতের ওয়্যারিং থেকে আগুন ছড়ানো রুখতে ‘মিডিয়ান সার্কিট ব্রেকার’ মজুত রাখা— তা-ও বলা হয়েছিল। বড়বাজারের ঘিঞ্জি গলির সাবেক বাড়িটি দেখিয়ে দিল, এ সব সতর্কতার বালাই নেই সেখানে। যে বাড়িগুলিতে প্রশাসন অভিযান চালায়, তারাও বড় একটা পরোয়া করেনি নিয়ম মানতে।

কেন মানা হয়নি কোনও সুপারিশ? প্রাক্তন দমকলমন্ত্রী প্রতিম চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘কমিটির সুপারিশের পরেই নতুন সরকার ক্ষমতায় এসেছিল। তা কার্যকর করার দায় নয়া সরকারের এক্তিয়ারে পড়ে।’’ বর্তমান দমকলমন্ত্রী শোভন চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘ওই কমিটির সুপারিশ সম্পর্কে আমি কিছু জানি না।’’

এমনিতেই বড়বাজার এলাকায় বেশ কয়েকটি বাড়িতে একই সঙ্গে বাণিজ্যিক অফিস চলছে এবং লোকজন বসবাসও করছেন। সতর্কতা সংক্রান্ত সুপারিশ না-মানলে সেই সব বাড়ির ট্রেড লাইসেন্স বাতিল করা হবে বলে এর আগে কয়েক বার প্রশাসনের তরফে হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছিল। স্টিফেন কোর্টের ঘটনার পরে ঝুঁকি নিয়ে ব্যবসা চালানো তথা গাফিলতির অভিযোগে কয়েকটি বাড়ির মালিককে গ্রেফতারও করে পুলিশ। কিন্তু এ সব কড়া পদক্ষেপ কখনওই স্থায়ী হয়নি। প্রশাসনের একটি অংশই বলছে, যারাই রাজ্যে ক্ষমতায় থাকুক, বড়বাজারের ব্যবসায়ীদের চটানোর মতো রাজনৈতিক সদিচ্ছা কেউই সে ভাবে দেখাতে পারেনি। ফলে, বড়বাজার আছে বড়বাজারেই।

বড়বাজারের বহুতলে আগুন লাগার পরিপ্রেক্ষিতে কলকাতার বিপজ্জনক বাড়িগুলির সংস্কারে নড়েচড়ে বসল রাজ্য সরকার। কলকাতার মেয়র তথা দমকলমন্ত্রী শোভন চট্টোপাধ্যায় মঙ্গলবার নবান্নে বলেন, ‘‘বিপজ্জনক বাড়ির সংস্কারে নতুন বিল আনা হবে। বিধানসভার আগামী অধিবেশনে ওই বিল পেশ হবে। কী ভাবে সকলের স্বার্থ রক্ষিত হবে, তা নিয়ে পর্যালোচনা চলছে।’’

পুরসভার হিসেবে, কলকাতায় বিপজ্জনক বাড়ির সংখ্যা ১২০০-এর মতো। সেগুলির কোনওটায় ভাড়াটে রয়েছে, কোনওটা বা ভূতের বাড়ির মতো ফাঁকাই পড়ে। পুরসভার হাতে কোনও পোড়ো ও ভগ্নপ্রায় বাড়িকে বিপজ্জনক ঘোষণা করার ক্ষমতা থাকলেও সেখানকার দীর্ঘ দিনের বাসিন্দাদের পুনর্বাসন দেওয়ার বন্দোবস্ত পুরবিধিতে নেই। নয়া বিলে সেই বন্দোবস্তই আনতে চাইছে সরকার। পুরকর্তারা বলছেন, বাড়িওয়ালা-ভাড়াটে দ্বন্দ্বে ওই পুরনো বাড়িগুলির সংস্কার বন্ধ। বহু বাড়ির মালিক অন্যত্র থাকেন, ভাড়াটেরা রয়ে গিয়েছেন। বাড়িওয়ালাদের বক্তব্য, যা ভাড়া মেলে তাতে সংস্কার করার প্রশ্নই ওঠে না। সংস্কার করতে হলে গাঁটের কড়ি খরচ করে করতে হবে, অথচ, ভাড়াটেরা ভাড়া বাড়াবেন না। এই টানাপড়েনে বিপজ্জনক বাড়িগুলির ভগ্নদশা দিনদিন বাড়ছে।

সরকারের প্রাথমিক ভাবনা, ভাড়াটেরা যে টুকু অংশ নিয়ে বাস করছেন, বিপজ্জনক বাড়ি ভেঙে সংস্কার করার পরে তাঁদের ওই অংশ ফিরিয়ে দেওয়া হবে। কিন্তু মালিক কত পাবেন, বাড়ির সংস্কার কিংবা নয়া বাড়ি তৈরি করবে কে, টাকাই বা কে ঢালবে, সে সব নিয়েই পর্যালোচনা চলছে বলে মেয়র জানিয়েছেন।

গত বছর নভেম্বর মাসে বিপজ্জনক বাড়ি নিয়ে পুরসভা একটি কমিটি গঠন করেছিল। সেই কমিটিতে ছিলেন সর্ব স্তরের নাগরিক। অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি প্রণব চট্টোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে কমিটি বাড়িওয়ালা-ভাড়াটে আইনের প্রয়োজনীয় বদল সংক্রান্ত সুপারিশও করেছে। তা আইনে রূপ দিতেই বিল আনা হবে বিধানসভায়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন