ঘরে ফেরার অপেক্ষা। সোমবার রাতে, ধর্মতলায়।
‘একটা দুর্গাপুর-আসানসোল হবে?’
‘দাদা, আমি বালুরঘাট।’ মানিকচক। চাঁচল। বেথুয়া। ইসলামপুর। শব্দগুলো ঘুরপাক খাচ্ছিল সোমবার রাতে, ধর্মতলার বাস গুমটিতে। লকডাউন শুরু হয়ে যাওয়ার পরেও বাড়ি ফেরার বাসের অপেক্ষায় সেখানে তখন শুধুই ভিন্ রাজ্যের শ্রমিকদের হাহাকার।
জমায়েত নিষিদ্ধ। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখুন।— লকডাউনের কলকাতার ওই তল্লাটে ঠাট্টা বলে মনে হচ্ছিল শব্দগুলো। সেখানে তখন ভিন্ রাজ্য থেকে শহরে ঢোকা পাড়াগাঁ-মফস্সলের গিজগিজে ভিড়। কয়েক হাত দূরে মাস্ক পরা এক পুলিশ অফিসার বললেন, ‘‘ও দিকে যাবেন না! ধর্মতলার ডিপো থেকে কিন্তু সকালে চার জনকে আইডি-তে টেস্ট করাতে নিয়ে গিয়েছিল। যা কাশছিল ওরা!’’
করোনার সংক্রমণ এড়াতে স্বাস্থ্যবিধি বা সতর্কতা অলীক বলে মনে হয় রাতের কলকাতার ওই কোণে। বিকেলে আজাদ হিন্দ এক্সপ্রেসে পুণে থেকে হাওড়ায় পৌঁছে কোলের মেয়েটাকে বিস্কুটের বেশি কিছু খেতে দিতে পারেননি সুনীতা কর্মকার। জলের অভাবে হাত ধোয়াও বিলাসিতা। পাশে দাঁড়িয়ে তাঁর স্বামী মানিক কর্মকার জানালেন, পুণেতে রাজমিস্ত্রির কাজ করেন তিনি। করোনা-ত্রাসে কাজ বন্ধ হওয়ায় এখন সপরিবার ঘরমুখো। কিন্তু মালদহে চাঁচলের বাড়িতে কী করে ফিরবেন, জানেন না। পাশেই কেরলের ত্রিশূর থেকে আসা দিনমজুরদের প্রায় সকলেরই বাড়ি নদিয়ার পলাশিতে। সাঁতরাগাছিতে ট্রেন থেকে নেমে ধর্মতলা পর্যন্ত কোনও মতে পৌঁছেছেন তাঁরা। ‘‘শিয়ালদহ স্টেশনটা কোন দিকে?’’— প্রশ্ন করতে করতে হেঁটে গেলেন সন্ন্যাসী সর্দার, নির্মল মণ্ডল, বাপি সর্দারেরা।
মেঙ্গালুরু থেকে ওই বিকেলেই হাওড়ায় নেমেছেন হোটেল কর্মচারী বিবেক রায়। শিলিগুড়ি ফিরবেন জনা সাতেক মিলে। মালদহের মহম্মদ আলম, বালুরঘাটের অভিজিৎ বর্মণ, পবিত্র মণ্ডল— সকলেরই অসহায় দশা! কারও পায়ে মজুরির টাকায় কেনা নতুন জুতো, কেউ উৎকণ্ঠা কাটাতে মোবাইলে গেম খেলছেন। বেশির ভাগেরই স্মার্টফোনের সঙ্গতি নেই। হেঁটে বাড়ি ফিরতে একটা ‘ডান্ডি-অভিযানের’ বাস্তবতা নিয়েও কেউ কেউ চর্চায় মশগুল।
বাস গুমটির পিছনে মানুষের বর্জ্যে দুর্গন্ধে টেকা দায়। কেরলের রংমিস্ত্রি, বেথুয়াডহরিগামী একটি দলের ক্ষোভ, ‘‘পুলিশই আমাদের করোনাভাইরাস বলে ডাকছে! ট্রেন-বাস বন্ধ করার সময়ে আমাদের কথা কেউ ভাবল না!’’
রাতে কয়েকটি জেলা থেকে অবশ্য তিন-চারটি বাস এসেছে। পুলিশি তৎপরতায় কয়েক জনের ফেরার বন্দোবস্ত হয়েছে। মঙ্গলবার ফোনে মালদহের মানিকচকের কাছে শ্রীপুরে পৌঁছনোর কাহিনি শোনালেন কেরল থেকে ফেরা রাজমিস্ত্রি মহম্মদ সামিউল। একটা ট্রাকে দরাদরি করে মাথাপিছু ১৫০০ টাকায় মালদহের চণ্ডীপুর অবধি যেতে পেরেছিলেন। তার পরে কিলোমিটার দশেক হণ্টন। দুপুর পর্যন্ত কেটেছে ডাক্তার দেখাতে। আড়াইডাঙার হাসপাতালে ৫০০ লোকের ভিড়। ডাক্তার কয়েক দিন বাড়ি থেকে না-বেরোনোর নির্দেশ দিয়েছেন সামিউলকে। তবে মঙ্গলবার রাত পর্যন্তও অচল কলকাতায় অসহায় গ্রাম-মফস্সলের কিছু চিহ্ন পড়েই থেকেছে।