শনিবার সকালে কার্যত ফাঁকা ভিআইপি রোড। ছবি: সুমন বল্লভ
গড়িয়াহাট মোড়ে মাস কয়েক আগে পুড়ে যাওয়া সেই গুরুদাস ম্যানসনের সামনের ফুটপাত। শনিবার দুপুরে সেখানেই একের পর এক হকার-স্টল পাখির খাঁচার মতো দাঁড়িয়ে। মাথায়, গায়ে প্লাস্টিকের আবরণ নেই। রয়েছে শুধুই দড়ির জট! আদ্যোপান্ত নেড়া একটি হকার-স্টলে আবার শুধুই দেবদেবীর মূর্তি ঝুলছে। স্টলের মালিক বললেন, ‘‘ঝড়ের ভয়ে কাল এ ভাবেই ফেলে রেখে চলে যেতে হয়েছিল। শুধু প্লাস্টিকটুকু খুলে দিতে পেরেছিলাম।’’ এর পরে বললেন, ‘‘আজও তো দেখছি ছুটি, অকারণ এলাম। বাজারে একটাও লোক নেই। আবার ঝড় হবে নাকি?’’
ঘূর্ণিঝড় ফণীর আশঙ্কায় বৃহস্পতিবারের পরে শুক্রবারও ছুটি দিয়ে দেওয়া হয় স্কুল-কলেজ, বিভিন্ন সরকারি দফতর। আপৎকালীন পরিস্থিতিতে কেউ কেউ কর্মক্ষেত্রে পৌঁছলেও বিকেলের পরে তাঁদেরও ঝড়ের আশঙ্কা নিয়ে বাড়ি ফিরে যেতে দেখা যায়! শনিবার আবহবিদদের আশ্বাসবাণী শুনে শহর কিছুটা সচল হলেও তাতে অবশ্য ‘সার্বিক ছুটি’র চিত্রটা বদলায়নি। এ দিন রাস্তায় গাড়ির চাপ উল্লেখযোগ্য ভাবে কম ছিল বলে জানিয়েছে কলকাতা ট্র্যাফিক পুলিশ। উল্টোডাঙা, ধর্মতলা, গড়িয়াহাটের মতো উল্লেখযোগ্য মোড়গুলিতে বাসে বাসে যাত্রীদের বাদুড়ঝোলা হওয়ার ছবি ধরা পড়েছে। যদিও যাত্রীরাই জানিয়েছেন, এর কারণ ভিড় নয়। রাস্তায় বাস বেশি নেই। ফলে হাতের কাছে যা মিলছে, তাতেই ঝুলে পড়ার চেষ্টা।
এমনিতে অর্ধদিবস ছুটির দিন হওয়ায় রাস্তায় বেশি লোক নামার সম্ভাবনা ছিল না। তবে ছুটির মেজাজটা ফণী যে আরও কয়েক গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে, তা মালুম হয় বিকেলের দিকে এসপ্লানেড এবং হাতিবাগান চত্বরের ছবিটা দেখে। দু’জায়গাতেই অধিকাংশ দোকান খোলা হয়নি। ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়েরই অভাব স্পষ্ট। ধর্মতলায় ক্রেতার অপেক্ষায় থাকা এক ব্যাগের দোকানের কর্মী, রেজাউল খান বললেন, ‘‘সকাল থেকে একটি ব্যাগও বিক্রি হয়নি। অকারণ এলাম। এর থেকে ঝড় হলেই ভাল হত। মালিককে বলে ছুটি নিতে পারতাম আজকের দিনটা।’’ কলকাতা পুরসভার পাশের এক পুরনো হোটেলের কর্মী সনৎ ঝা আবার বলছেন, ‘‘এক দিন না এলেই মাইনে কাটে। তাই ঝড় হোক, চাই না। আমাদের তো আসতেই হত।’’ এ দিকে, ঝড়ের ভয়ে যে সব প্লাস্টিকের ছাউনি সরিয়ে ফেলা হয়েছিল বিভিন্ন বাজার চত্বর থেকে, তা ফণীর শঙ্কা কাটতেই ধীরে ধীরে ফিরতে শুরু করল স্বস্থানে। এক-দু’দিনেই পুরনো ছন্দে ফিরবে ব্যবসা।
সমাজতত্ত্বের শিক্ষক অভিজিৎ মিত্র বলছেন, ‘‘ঝড়ের আশঙ্কার থেকেও এ হল একটি দিন বাড়তি ছুটি পাওয়ার অছিলা। বারবার কলকাতা প্রমাণ করে যে, তার কর্মসংস্কৃতি বদলায়নি।’’ সেই সঙ্গে তাঁর সংযোজন, ‘‘উৎসব বুঝি ‘কম পড়িয়াছে’। তাই আরও একটি উৎসবের নাম এখন ‘ফণী’। এর রেশ আরও কয়েক দিন চলবে।’’ দুপুরে হাতিবাগান মোড়ে আবার সপরিবার ঘুরছিলেন সিঁথির বাসিন্দা তানিয়া দত্ত। সদ্য তথ্য-প্রযুক্তি সংস্থায় কাজে যোগ দেওয়া তানিয়া বললেন, ‘‘নতুন চাকরি উপলক্ষে পরিবারের লোকজনকে খাওয়ানোর কথা ছিল। এর থেকে ভাল দিন আর হয় না। চাকরি পাওয়ার পর থেকে দেড় মাসে একটি দিনও ছুটি পাইনি। ঝড় হোক বা না হোক, একটি ছুটি তো পাওয়া গেল!’’ মনোরোগ চিকিৎসক অনিরুদ্ধ দেব আবার বললেন, ‘‘ফণীর ছুটি চলছে এখন। অন্য দিন চেম্বার করে রাত ৮টায় বাড়ি ফিরি। আজ বিকেল সাড়ে চারটেতেই হয়ে গেল। বেশি রোগী আসেননি।’’ তাঁর মতে, ‘‘আমাদের কম কাজ করার একটি প্রবণতা আছে। সঙ্গে ফণী নিয়ে খানিকটা ভয়ও যুক্ত হয়েছে। কিন্তু আজ মনে হয় মানুষের ভয় কম, ফাঁকির চিন্তা বেশি ছিল।’’