বরাহনগরের অভিজাত আবাসনে দুঃসাহসিক ডাকাতি

ডানলপে বেঁধে রাখা রয়েছে বাড়ির কর্তাকে। ছয় বছরের ছেলেকে স্কুল থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হবে। তাই কথা না বাড়িয়ে আলমারির চাবি দিয়ে দিলেই ভাল! এই সমস্ত হুমকি দিয়েই আগ্নেয়াস্ত্র দেখিয়ে চার দুষ্কৃতী লুঠপাঠ চালিয়েছে বলে অভিযোগ বরাহনগরের এক অভিজাত আবাসনের ব্যবসায়ী পরিবারের।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ৩১ অগস্ট ২০১৫ ২১:৫৫
Share:

ডানলপে বেঁধে রাখা রয়েছে বাড়ির কর্তাকে। ছয় বছরের ছেলেকে স্কুল থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হবে। তাই কথা না বাড়িয়ে আলমারির চাবি দিয়ে দিলেই ভাল! এই সমস্ত হুমকি দিয়েই আগ্নেয়াস্ত্র দেখিয়ে চার দুষ্কৃতী লুঠপাঠ চালিয়েছে বলে অভিযোগ বরাহনগরের এক অভিজাত আবাসনের ব্যবসায়ী পরিবারের।

Advertisement

সোমবার প্রকাশ্য দিবালোকে বরাহনগরের বিটি রোড সংলগ্ন ‘মালঞ্চ’ আবাসনে এই ডাকাতির ঘটনার রহস্য দানা বেঁধেছে। লুঠপাঠ চালানোর সময় ওই দুষ্কৃতীরা কী ভাবে পরিবারের কোন সদস্য কোথায় রয়েছে এবং ঘরের কোথায় কী রয়েছে তা জানলেন সে নিয়েই উঠেছে প্রশ্ন। তাই ওই ডাকাত দলের সবাই কি অপরিচিত ছিল না ওই ব্যবসায়ী পরিবারের অতি পরিচিত কেউ এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত তা নিয়ে ধন্দে রয়েছেন তদন্তকারীরাও।

ব্যারাকপুরের পুলিশ কমিশনার নীরজ সিংহ বলেন, ‘‘সমস্ত দিক খতিয়ে দেখে প্রাথমিক ভাবে মনে হচ্ছে এই ডাকাতির ঘটনার সঙ্গে ওই পরিবারের পরিচিত কেউ জড়িত থাকতে পারেন। বেশ কিছু সূত্র মিলেছে। গোয়েন্দা প্রধান নিজে বিষয়টি দেখছেন।’’

Advertisement

কী ঘটেছিল ঘটনাটি?

বরাহনগরের অনন্যা সিনেমা বাস স্টপ এলাকায় বিটি রোড থেকে ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে রয়েছে এই আবাসন। আটটি ব্লকের এই আবাসনে প্রায় ১৯০টি পরিবার রয়েছেন। সেখানেই ‘সি’ ব্লকের পাঁচতলায় বহু বছর ধরে স্ত্রী রুমা গাঙ্গোপাধ্যায়, ১৭ বছরের মেয়ে পূজা ও ছ’বছরের ছেলেকে নিয়ে থাকেন পেশায় আমদানি-রফতানির ব্যবসায়ী রবি গঙ্গোপাধ্যায়। পূজা একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের একাদশ শ্রেণির ছাত্রী। রবিবাবুর ছেলে কামারহাটির একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের প্রথম শ্রেণির ছাত্র।

পুলিশ সূত্রের খবর, এ দিন সকালে ছেলে স্কুলে চলে যাওয়ার পরে ৯টা নাগাদ রুমাদেবী ও পূজাকে সঙ্গে নিয়ে ডানলপের একটি মেডিক্যাল সেন্টারে গিয়েছিলেন রবিবাবু। সেখানে রুমাদেবীর আল্ট্রা সনোগ্রাফি হওয়ার পরে সকাল ১১টা নাগাদ স্ত্রী ও মেয়েকে বাড়ি ফেরার জন্য অটোয় তুলে দিয়ে চাঁদনি চক এলাকায় নিজের অফিসে যাওয়ার জন্য বাসে উঠে পড়েন রবিবাবু। সেই সময় তাঁদের বাড়িতে ছিলেন পরিচারিকা লতিকা গুঁই ও গৃহশিক্ষিকা লীনা মণ্ডল। তদন্তে পুলিশ জেনেছে, বৌবাজারের বাসিন্দা লীনাদেবী এক সময় পূজাকে পড়াতেন। এখন তিনি রবিবাবুর ছেলেকে পড়ান। এ দিন তিনি ১১টা নাগাদ এসেছিলেন। পুলিশ জানায়, সওয়া ১১টা নাগাদ পূজা ও রুমাদেবী বাড়ি ফেরেন। এর পরেই পাড়ার দোকান থেকে জিনিস কিনতে বেরিয়ে যান পূজা। মি‌নিট পনেরোর মধ্যেই সে ফিরে আসে। আর তার পিছনেই ঢোকে দুই যুবক।

রুমাদেবীরা পুলিশকে জানিয়েছেন, ফ্ল্যাটের যে ঘরে এসি রয়েছে সেখানেই তিনি, লতিকাদেবী ও শিক্ষিকা লীনা বসেছিলেন। পূজাও এসে ওই ঘরে ঢোকে। অভিযোগ, এর পরেই আচমকা দুই অপরিচিত যুবক দরজা ঠেলে ওই ঘরে ঢুকে পড়ে। দু’জনের হাতেই ছিল আগ্নেয়াস্ত্র। রুমাদেবী বলেন, ‘‘এক জন আমার ও পূজার মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে বলে ‘বেশি চিৎকার করবি না। করলে গুলি চালাবো। আলমারির চাবি বের করে দে। গয়না বের কর।’ ’’ অভিযোগ, এর পরে আরও দু’জন দুষ্কৃতী আগ্নেয়াস্ত্র হাতে সেখানে আসে। এর পরে চাবি দিয়ে আলমারি খুলে সমস্ত জিনিসপত্র বের করে। কিন্তু, তাতে কিছু না মেলায় দুষ্কৃতীরা আরেকটি আলমারির লকারের চাবি চায় বলে দাবি রুমাদেবীর। তিনি বলেন, ‘‘ওঁরা বলে ‘চাবি দে। তোর বরকে ডানলপে বেঁধে রেখেছি। ছেলেকে স্কুল থেকে তুলে নেব।’ ’’ তবে চাবি দিতে না পারায় শেষে দুষ্কৃতীরা একটা লোহার রড দিয়ে লকার ভেঙে কয়েক লক্ষ টাকার সোনার গয়না বের করে। নিজেদের সঙ্গে থাকা একটি ছোট ব্যাগ ও ওই ঘর থেকে আরেকটি ব্যাগ নিয়ে তাতে ভরে নেয় গয়নাগুলি।

লতিকাদেবী ও লীনাদেবী জানান, দুষ্কৃতীরা তাঁদের কান, গলা থেকেও গয়না খুলে নেন। এমনকী তিনটি মোবাইলও নিয়ে নেয়। তবে পুজার মোবাইলটি প্রথমে নিলেও পরে তা ফেরত দিয়ে দেয়। পুজা বলেন, ‘‘ওঁদের এক জনকে কোথায় যেন দেখেছি। ওঁরা বার বার একটা ভুল নাম করে বলছিল, আমার বাবা নাকি ওঁদের এক জনের মায়ের ক্ষতি করেছে।’’ শুধু তাই নয়। পূজার কান থেকে সোনার দুল খুলে নিয়ে তা আবার ফেরৎ দিয়ে দেয় ওই দুষ্কৃতীরা। অভিযোগ, এর পরে গামছা, মোজা, সোয়েটার দিয়ে তিন জনের হাত, পা, মুখ বেঁধে রেখে দুষ্কৃতীরা ফ্ল্যাটের দরজা বাইকে থেকে বন্ধ করে চলে যায়।

রুমাদেবী পুলিশকে জানান, লতিকাদেবী কোনও মতে বাঁধন খুলে সবাইকে মুক্ত করেন। এর পরে প্রতিবেশীদের ফোন করে সব জানান রুমাদেবী। পড়শিরাই এসে দরজা খুলে তাঁদের উদ্ধার করে। কিন্তু চার অপরিচিতকে ওই আবাসনের কেউ এমনকী নিরাপত্তা রক্ষীও বেরতে দেখেননি কেন, তা নিয়ে ধন্দে রয়েছেন তদন্তকারীরাও।

তবে তদন্তে পুলিশ জেনেছে, এ দিন সকাল সাড়ে ১১টা নাগাদ দুই অপরিচিত ব্যক্তি ওই আবাসনে এসেছিলেন। তাঁরা রবিবাবুর বাড়িতে যেতে চাইলে নিরাপত্তারক্ষী বিশ্বনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁদের আটকান। কিন্তু ওই ব্যক্তিরা জানান, তাঁরা রবিবাবুর ফ্ল্যাটে এসি সারাতে এসেছেন। বিশ্বনাথবাবু বলেন, ‘‘ওঁরা আমাকে ফোন করে রবিবাবুর সঙ্গে কথা বলিয়ে দিয়েছিলেন। ফোনের অপর প্রান্ত থেকে বলল ‘আমি রবিদা বলছি। ওঁদের যেতে দাও’। এর পরেই দু’জনকে যেতে দিলাম।’’ তবে আবাসনের খাতায় নিজেদের পরিচয় তেমন ভাবে ওই ব্যক্তিরা লেখেননি বলেই জেনেছে পুলিশ। বছর আটান্নর বিশ্বনাথবাবু পুলিশের কাছে দাবি করেছেন, তিনি ওই ব্যক্তিদের আর বাইরে বেরতে দেখেননি। আবার ওই সি ব্লকেরই একতলার বাসিন্দা রাখি গোয়েল বলেন, ‘‘পৌনে ১২টা নাগাদ দু’জনকে নীচে ঘুরতে দেখি। কোথায় যাবেন জিজ্ঞাসা করতে বলে উপরে কাজ চলছে। এর পরেই ওঁরা উপরে উঠে যায়।’’

এ দিন বিকেলে ব্যারাকপুর পুলিশ কমিশনারেটের কর্তারা এবং ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞরা ঘটনাস্থলে আসেন। প্রত্যক্ষদর্শীদের থেকে বিবরণ শুনে দুষ্কৃতীদের ছবিও আঁকায় পুলিশ। রবিবাবু বলেন, ‘‘অফিসে চলে গিয়েছিলাম। খবর পেয়ে ফিরে আসি। মনে হচ্ছে পরিচিত কেউই এই কাজে যুক্ত। না হলে সব খবর জানলো কি করে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন