টাকা নেই, তাই ঝাঁপ পড়ল রক্তদান শিবিরে

পরপর শিবির বাতিল। রক্তের আকাল। নোট বাতিলের ধাক্কা এ বার রক্তদান শিবিরেও। এক মাসের মধ্যে ৫৫টি রক্তদান শিবির বাতিল হয়েছে শুধু মানিকতলায় কেন্দ্রীয় ব্লাড ব্যাঙ্কেই। শিবির করবেন বলে নাম লিখিয়েও শেষ মুহূর্তে উদ্যোক্তারা ওই কেন্দ্রীয় ব্লাড ব্যাঙ্ককে জানাচ্ছেন, তাঁরা ক্যাম্প করতে পারছেন না।

Advertisement

পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৮ ডিসেম্বর ২০১৬ ০০:২৩
Share:

পরপর শিবির বাতিল। রক্তের আকাল। নোট বাতিলের ধাক্কা এ বার রক্তদান শিবিরেও।

Advertisement

এক মাসের মধ্যে ৫৫টি রক্তদান শিবির বাতিল হয়েছে শুধু মানিকতলায় কেন্দ্রীয় ব্লাড ব্যাঙ্কেই। শিবির করবেন বলে নাম লিখিয়েও শেষ মুহূর্তে উদ্যোক্তারা ওই কেন্দ্রীয় ব্লাড ব্যাঙ্ককে জানাচ্ছেন, তাঁরা ক্যাম্প করতে পারছেন না। কেন্দ্রীয় ব্লাড ব্যাঙ্কের ইতিহাসে এমন গণহারে শিবির বাতিলের নজির আছে বলে মনেই করতে পারছেন না কর্তারা। বলা হচ্ছে, নোট বাতিলই এর মূল কারণ।

ব্লাড ব্যাঙ্ক এবং স্বাস্থ্য দফতরের রক্ত নিরাপত্তা বিভাগ সূত্রের খবর, রক্তদান শিবিরের উদ্যোক্তা ক্লাবগুলি মৌখিক ভাবে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে একটাই কথা বলছেন— ‘টাকা নিয়ে এই ডামাডোলের বাজারে আপাতত ক্যাম্পের ব্যাপারে কেউ উৎসাহী নন।’ শুধু মানিকতলার ব্লাডব্যাঙ্ক নয়, এসএসকেএম বা নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজের ব্লাড ব্যাঙ্কের মতো অনেক জায়গাতেও একই পরিস্থিতি। নভেম্বর মাসে এসএসকেএমে ১২টি শিবির বাতিল করেছেন উদ্যোক্তারা, এনআরএসে বাতিল হয়েছে ১৪টি। যেখানে শুধু শনি-রবিবারেই ব্লাড ব্যাঙ্কগুলি ১৬-১৭টি শিবির পেত, সেখানে এখন পাচ্ছে মাত্র ৬-৭টি। অথচ রক্তদানের ক্ষেত্রে এটিই সবচেয়ে ভাল সময় বলে মনে করা হয়। ডিসেম্বর এবং জানুয়ারি মাসকে বলা হয় ‘সারপ্লাস মান্‌থ’। এই সময়ে সবচেয়ে বেশি রক্ত সংগ্রহ হয়, তাই ব্লাড ব্যাঙ্কে অতিরিক্ত রক্ত মজুত থাকে। এ বার সেই সময়েই রক্ত-সঙ্কট দেখা দেওয়ায় চিন্তিত কর্তারা।

Advertisement

সরকারি ব্লাড ব্যাঙ্কগুলি এমনিতেই টেকনিশিয়ানের অভাবের কথা জানিয়ে কিছু দিন ধরে প্রচুর রক্তদান শিবির প্রত্যাখ্যান করছিল। এ বার উদ্যোক্তারাও শিবিরের আয়োজন থেকে পিছিয়ে যাচ্ছেন। ফলে ডিসেম্বরের শুরুতেই রাজ্যে রক্তসঙ্কট চরমে। যেমন যে কোনও দিন কেন্দ্রীয় ব্লাড ব্যাঙ্কে অন্তত ৪০০-৪৫০ ইউনিট রক্ত থাকার কথা, কিন্তু গত মঙ্গলবার মানিকতলা ব্লাড ব্যাঙ্কে মজুত ছিল মাত্র ১৪৫ ইউনিট হোল ব্লাড। হাসপাতালের ব্লাড ব্যাঙ্কে থাকার কথা ১৫০-১৭০ ইউনিট। সেখানে মঙ্গলবারের হিসেব, এসএসকেএমে ছিল ৬১ ইউনিট ও এনআরএসে ৫২ ইউনিট হোল ব্লাড।

আপাত ভাবে দেখলে টাকার সঙ্গে স্বেচ্ছায় রক্তদান শিবিরের কোনও যোগাযোগ থাকার কথাই নয়। কিন্তু ভিতরে অন্য সমীকরণ রয়েছে। রক্তদান আন্দোলনের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে জড়িত ডি আশিস, দীপঙ্কর মিত্র, অপূর্ব ঘোষেরাই জানাচ্ছেন, পাড়ায়-পাড়ায় রক্তদান শিবির আয়োজন করে প্রধানত শাসক দলের মদতপুষ্ট ক্লাবগুলি। আর শাসকদলের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখতে তাদের ক্যাম্পের টাকা দেন মূলত ব্যবসায়ী আর প্রোমোটারেরা। মোটামুটি ১০০ জন রক্তদাতা থাকলে ১ থেকে দেড় লক্ষ টাকা বাজেট হয়। প্যান্ডেল, চেয়ার, তক্তপোষ, সাউন্ড সিস্টেম, আলো, রক্তদাতাদের খাবারের বড় প্যাকেট ছাড়াও পাড়াজুড়ে দেদার খাওয়াদাওয়া। রক্তদাতাদের খাবারের জন্য মাথা পিছু ২৫ টাকা করে অবশ্য দেওয়ার কথা সরকারের। কিন্তু অভিযোগ, সেই টাকা পেতে সাধারণত দেড় থেকে তিন বছর সময় পেরিয়ে যায়। ফলে সেই টাকাও শিবিরের সময়ে জোগাড় করতে হয় উদ্যোক্তাদেরই। এত কিছুর পরে খানিকটা টাকা বাঁচাতেও চেষ্টা করতেন উদ্যোক্তারা, যাতে ক্লাবের ফান্ডের জন্যও কিছু থাকে।

দীপঙ্করবাবুদের কথায়, ‘‘ওই ব্যবসায়ী, প্রোমোটারদের একটা বড় অংশ এখন কালো টাকা সাদা করা নিয়ে নাজেহাল। অন্য দিকে, তাঁদের ব্যবসাও এখন মন্দা। তাঁরা এখন রক্তদান শিবিরে টাকা দেওয়ার কথা ভাবছেনই না। ক্লাবগুলিও তাই পিছিয়ে আসছে।’’ অপূর্ববাবু আবার জানান, ৫৫ শতাংশ শিবিরে ৪০০-১২০০ টাকা দামের উপহার দেওয়া হয়। টাকার জোগান কমেছে বলে উপহার আসছে না। উপহার না থাকলে রক্তদাতারাও উৎসাহী হচ্ছেন না। বৌবাজারের একটি ক্লাব তাদের ২৭ নভেম্বরের ক্যাম্প বাতিল করেছে। তার কোষাধ্যক্ষের প্রশ্ন, ‘‘ব্যাঙ্কের লাইনে দাঁড়াব, নাকি রক্তদান শিবির করব?’’

মানিকতলা কেন্দ্রীয় ব্লাড ব্যাঙ্কে গত ৮ নভেম্বর থেকে ৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত সাকুল্যে ৬৪টি শিবির হয়েছে। রক্তের সঞ্চয় তলানিতে। অধিকর্তা কুমারেশ হালদারের কথায়, ‘‘নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে এত সঙ্কট, এত কম শিবির কখনও দেখিনি। সব হচ্ছে রাজনৈতিক ডামাডোলের জন্য। কেন এই রাজনৈতিক অস্থিরতা, বুঝে নিন।’’ এসএসকেএমের ব্লাড ব্যাঙ্কের দায়িত্বে থাকা প্রতীক দে-র কথায়, ‘‘অনেক ক্যাম্প বাতিল হচ্ছে। উদ্যোক্তারা মুখে বলছেন, টাকা তোলা যাচ্ছে না বলে তাঁরা নিরুপায়। ক্যাম্প বুকিংও অর্ধেক হয়ে গিয়েছে। রক্তাভাব এতই যে ডোনার ছাড়া রক্ত দিতে পারছি না।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন