ডেঙ্গির মহানগরে প্লেটলেটের জন্য হাহাকার

সেন্ট্রাল ব্লাড ব্যাঙ্কে ২। এনআরএসে ২৬। কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে ৪০। ন্যাশনাল মেডিক্যালে ১৮। আর জি করে ৩২। এবং এসএসকেএমে ১৮। মঙ্গলবার দুপুরে কলকাতার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালগুলিতে এই পরিসংখ্যানটা সেখানে মজুত প্লেটলেটের। অথচ, কেন্দ্রীয় ব্লাড ব্যাঙ্কে রোজ প্লেটলেটের চাহিদা অন্তত ৩০০ থেকে ৩৫০ ইউনিট।

Advertisement

সোমা মুখোপাধ্যায় ও পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৩ অগস্ট ২০১৬ ০২:১৬
Share:

সেন্ট্রাল ব্লাড ব্যাঙ্কে ২। এনআরএসে ২৬। কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে ৪০। ন্যাশনাল মেডিক্যালে ১৮। আর জি করে ৩২। এবং এসএসকেএমে ১৮। মঙ্গলবার দুপুরে কলকাতার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালগুলিতে এই পরিসংখ্যানটা সেখানে মজুত প্লেটলেটের।

Advertisement

অথচ, কেন্দ্রীয় ব্লাড ব্যাঙ্কে রোজ প্লেটলেটের চাহিদা অন্তত ৩০০ থেকে ৩৫০ ইউনিট। মেডিক্যাল কলেজগুলিতে ১০০ থেকে ১৫০ ইউনিট। মজুত প্লেটলেটের এই হিসেবই বলে দিচ্ছে পরিস্থিতিটা আদতে কী। এ দিনই নবান্নে ডেঙ্গি পরিস্থিতি নিয়ে বৈঠকের পরে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছিলেন, ২৪ ঘণ্টা‌ই যাতে ব্লাড ব্যাঙ্কে গিয়ে পরিষেবা পাওয়া যায়, সে ব্যাপারে যথাযথ ব্যবস্থা নিচ্ছেন তাঁরা। কিন্তু শুধু ব্লাড ব্যাঙ্ক খোলা পেলেই তো হবে না, সেখানে গিয়ে কী পাবে রোগীর পরিবার? রাজ্যে এখন সর্বত্রই প্লেটলেটের আকাল।

চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, হেমারেজিক ডেঙ্গি হলে অনেকেরই লোহিত রক্তকণিকা ভেঙে যায়। প্লেটলেট কমে হু-হু করে। সময় মতো প্লেটলেট না-পেলে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। অথচ সরকারি ব্লাড ব্যাঙ্কে প্লেটলেটের আকাল চলছেই। প্রশ্ন উঠেছে, পাড়ায় পাড়ায় যে এত রক্তদান শিবির হচ্ছে, সেই রক্ত যাচ্ছে কোথায়? স্বাস্থ্য দফতরের কর্তাদের বড় অংশ স্বীকার করেছেন, রক্তের উপাদান বিভাজনের কাজ ঠিক মতো না হওয়াতেই এই বিপত্তি।

Advertisement

কেন হচ্ছে না ঠিক মতো বিভাজনের কাজ? এ ক্ষেত্রে ফের উঠে এসেছে পরিকাঠামোগত একাধিক ত্রুটির কথা। অধিকাংশ ব্লাড ব্যাঙ্কেই কর্মীর আকাল। প্রায় সর্বত্রই বহু পদ খালি। বাতিল হচ্ছে কিছু কিছু শিবির। যেটুকু হচ্ছে, সেখান থেকেও সংগৃহীত রক্তের বিভাজনের কাজে অধিকাংশ সময়েই ত্রুটি থেকে যাচ্ছে। যে সব ব্লাড ব্যাঙ্কে রক্তের উপাদান ভাগ করার যন্ত্র আছে, সেখানে ডাক্তার-টেকনিশিয়ানের অভাবে কাজ থমকে।

জাতীয় এডস নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ সংস্থা (ন্যাকো) রক্তের উপাদান বিভাজনের ব্যাপারে কড়া নির্দেশ দেওয়া সত্ত্বেও অধিকাংশ সরকারি ব্লাড ব্যাঙ্ক যথেষ্ট পরিমাণ প্লেটলেট তৈরি করছে না। এক ইউনিট রক্ত থেকে উপাদান পৃথক করে লোহিত কণিকা, প্লেটলেট বা অণুচক্রিকা এবং ফ্রেশ ফ্রোজেন প্লাজমা পাওয়া যায়। কিছু দিন আগেই অভিযোগ উঠেছিল, প্লেটলেট যাতে তৈরি করতে না হয়, সে জন্য চার প্রকোষ্ঠ বিশিষ্ট ব্লাড ব্যাগ কেটে দুই প্রকোষ্ঠের করে দিচ্ছিল মানিকতলার কেন্দ্রীয় ব্লাড ব্যাঙ্ক, আরজিকর ব্যাঙ্ক সহ একাধিক ব্লাড ব্যাঙ্ক। সে ক্ষেত্রেও নেপথ্যের কারণ ছিল কর্মীর অভাব।

রাজ্য রক্ত সঞ্চালন পর্ষদের এক কর্তা বলেন, ‘‘রক্তদান শিবিরের জন্য অভিজ্ঞ ডাক্তার এবং টেকনিশিয়ান দরকার। রক্তের উপাদান পৃথক করার জন্যও দরকার তাঁদের। কিন্তু গত আট বছর এ রাজ্যে ব্লাড ব্যাঙ্কে পূর্ণ সময়ের ডাক্তার বা টেকনিশিয়ান নেওয়া হয়নি। ফলে সাধারণ মানুষ এগিয়ে আসা সত্ত্বেও রক্তের সঙ্কট কাটছে না। এটা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক।’’

কেন নিয়োগের বিষয়টি নিয়ে ভাবনা-চিন্তা করছে না স্বাস্থ্য দফতর? দফতরের এক কর্তার যুক্তি, ‘‘বাম আমলে কয়েক বছর নিয়োগ পুরো বন্ধ ছিল। তাই শূন্য পদের সংখ্যা এক ধাক্কায় অনেকটা বেড়ে গিয়েছে। ধাপে ধাপে তা পূরণের চেষ্টা চলছে। স্বাভাবিক হতে সময় লাগবে।’’

এ দিকে, প্লেটলেট আবার পাঁচ দিনের বেশি সংরক্ষণও করা যায় না। তই নিয়মিত রক্তের উপাদান বিভাজন না হলে প্লেটলেটের জোগান স্বাভাবিক হওয়ার সম্ভাবনা নেই। অথচ প্লেটলেট শুধু যে ডেঙ্গি রোগীদের জন্যই লাগে তা নয়। চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, ক্যানসার রোগী, রক্ত জমাট বাঁধার সমস্যা রয়েছে যাঁদের, তাঁদের জন্যও প্লেটলেট প্রয়োজন। ফলে বহু রোগীর পরিবারকেই খালি হাতে ফিরতে হচ্ছে। স্বাস্থ্যকর্তাদের বক্তব্য, তাঁদের ব্লাড ব্যাঙ্ক থেকে ৩০ কিলোমিটারের মধ্যে যে ক্যাম্পগুলি হয়, তাঁরা শুধু সেখান থেকে সংগৃহীত রক্তেরই প্লেটলেট তৈরি করতে পারেন। কারণ, রক্ত নেওয়ার ছ’ঘণ্টার মধ্যে প্লেটলেট তৈরি করতে হয়। পরিবহন এবং যানজটের যা সমস্যা, তাতে ৩০ কিলোমিটারের বেশি দূরত্বে ক্যাম্প হলে প্লেটলেট সংরক্ষণ সম্ভব হয় না।

তা হলে কি এ ভাবেই রক্তসঙ্কটের খেসারত দেবেন সাধারণ মান়ুষ?

রক্ত সুরক্ষা বিভাগের ডেপুটি ডিরেক্টর নয়ন চন্দ জানান, তিনি এ ব্যাপারে কোনও মন্তব্য করবেন না। একই কথা জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় ব্লাড ব্যাঙ্কের অধিকর্তা কুমারেশ হালদার। তবে স্বাস্থ্য দফতরের এক শীর্ষ কর্তা বলেন, ‘‘কর্মীর অভাব কম-বেশি সব বিভাগেই আছে। কিন্তু এখানে সদিচ্ছার অভাবটা তার চেয়েও বেশি প্রকট। পরিকাঠামো থাকা সত্ত্বেও শুধুমাত্র বেশি সময় লাগে বলে প্লেটলেট তৈরিতে মন দিচ্ছেন না বেশির ভাগ ব্লাড ব্যাঙ্কের কর্মীরা। একটা অসাধু চক্র এর পিছনে সক্রিয়। তারা মানুষকে বেসরকারি ব্লাড ব্যাঙ্কের দিকে ঠেলছে। এই চক্রটা ভাঙা সবচেয়ে আগে দরকার। সে নিয়ে আমাদের ভাবনা-চিন্তা চলছে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন