অগ্নিকাণ্ডের পরে। রবিবার। — নিজস্ব চিত্র।
সিনেমা হলটা বছর আটেক আগে বন্ধ হয়ে গেলেও এখনও ওখানে বাসস্টপ সেই নামে। আবার, হল না থাকলেও দোতলা বাড়িটা ছিল। ওটাই বহু বছর ধরে ল্যান্ডমার্ক বা পথ-নির্দেশক। শনিবার গভীর রাতে ধর্মতলার লেনিন সরণিতে পুড়ে ছাই হয়ে গেল জ্যোতি সিনেমার সেই বাড়িও।
আগুন এতটাই বিধ্বংসী ছিল যে তা নিয়ন্ত্রণে আনতে দমকলের ২৬টি ইঞ্জিনের ঘণ্টা দুয়েক সময় লেগে যায়। আশপাশের বাড়ি ও বস্তিতে থাকা মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়ালেও কেউ হতাহত হননি। জ্যোতি সিনেমা ছিল ওই দোতলা বাড়িতে। তার লাগোয়া, একই চৌহদ্দিতে থাকা একটি পাঁচতলা বাড়িতে বহু ভাড়াটে থাকেন। তাঁদের সঙ্গে বাড়ির মালিকের বিবাদ চলছে বেশ কিছু দিন। আগুনে ওই পাঁচতলা বাড়িটিরও ক্ষতি হয়েছে। আগুন ধরা এবং তা দ্রুত ছড়ানোর পিছনে পাঁচতলা ওই বাড়ি থেকে ভাড়াটেদের হটিয়ে প্রোমোটারির চক্রান্তের ছায়া দেখছেন পুলিশ-প্রশাসন ও বাসিন্দাদের একাংশ।
আগুন লাগার খবর পেয়ে বেহালার বাড়ি থেকে রাত আড়াইটে নাগাদ ঘটনাস্থলে পৌঁছন দমকলমন্ত্রী তথা কলকাতার মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়। তাঁর কথায়, ‘‘মাত্র ১৫ মিনিটের মধ্যে দ্রুত আগুন ছড়িয়ে পড়াটা সন্দেহজনক। ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞরা বিষয়টি অনুসন্ধান করে দেখবেন।’’ মেয়র বলেন, ‘‘কয়েক মাস ধরে শুনে আসছি জ্যোতি বিক্রি হয়ে যাবে। ওই হল লাগোয়া বাড়িতে বহু ভাড়াটে থাকেন। মালিকের সঙ্গে তাঁদের বিবাদ চলছে। ভাড়াটেদের সরে যেতে বাধ্য করার জন্য এমন ঘটানো হল কি না, তা খতিয়ে দেখতে হবে।’’
অতীতে কলকাতার একাধিক সিনেমা হলে অগ্নিকাণ্ডের পরে সেই জায়গায় ধীরে ধীরে হোটেল, বহুতল গজিয়ে উঠেছে। জ্যোতি সিনেমা যে বাড়িতে ছিল, পরে তার দোতলায় ডাক্তারদের একটি প্রশিক্ষণকেন্দ্র আর একতলায় অ্যালুমিনিয়ামের সরঞ্জাম বিক্রির দোকান গড়ে ওঠে। সে সব পুড়ে গিয়েছে শনিবার রাতের আগুনে। অভিযোগ উঠেছে, একই চৌহদ্দিতে থাকা দু’টি বাড়ি গুঁড়িয়ে সেই জায়গায় বহুতল তৈরির পরিকল্পনা ছিল।
পুলিশ ও দমকল সূত্রের খবর, আগুন লাগে রাত দেড়টা নাগাদ। লাগোয়া পাঁচতলা ফ্ল্যাটবাড়ি, গা ঘেঁষা মর্ট লেন ও নীলমণি হালদার লেনের বস্তির বাসিন্দাদের প্রায় সবাই তখন ঘুমিয়ে। কিন্তু অন্যদের চিৎকার শুনে ও ধোঁয়া দেখে আগুন লেগেছে বলে টের পাওয়ার পরে তাঁরা নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে দৌড়োদৌড়ি শুরু করেন। ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, চারদিকে বিশৃঙ্খল অবস্থা। আগুন বস্তিকেও গ্রাস করে নিতে পারে, এই আশঙ্কায় অপরিসর গলি ছে়ড়ে অধিকাংশই তখন ঠাঁই নিয়েছেন লেনিন সরণিতে। একই হাল পাঁচতলা বাড়ির বাসিন্দাদের।
স্থানীয় ব্যবসায়ী আলমগির মল্লিক তাঁর স্ত্রী ও শিশু-সন্তানদের নিয়ে ওই বাড়ির দোতলার একটি ফ্ল্যাটে ঘুমোচ্ছিলেন। তাঁর কথায়, ‘‘রাত দেড়টা নাগাদ ফ্যান বন্ধ হয়ে যাওয়ায় গুমোট গরমে ঘুম ভেঙে যায়। তখনই আশপাশের লোকজনের চিৎকার শুনি। ঘর থেকে বেরোতেই প্রবল ধোঁয়ায় দম বন্ধ হওয়ার মতো অবস্থা। সবাইকে নিয়ে কোনও রকমে নীচে নেমে বড় রাস্তায় চলে আসি।’’
স্থানীয় সূত্রের খবর, পাঁচতলা ওই বাড়িতে দশটি পরিবারের বাস। জ্যোতি সিনেমা হলে একদা কর্মরত দারোয়ান জাগো সিংহ এখনও ওই বাড়িরই নিরাপত্তারক্ষী হিসেবে কাজ করেন। তাঁর কথায়, ‘‘বোমা ফাটার মতো বিকট শব্দ হল। তার পরে ধোঁয়ার গন্ধ। রাত দেড়টা নাগাদ ঘুম ভেঙে যায়। চোখ খুলতেই দেখি, পাশের বাড়িতে দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে। চিৎকার করে সবাইকে ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে নীচে নামতে বলি।’’
আগুনের তীব্রতা তখন ক্রমেই বাড়ছে। রাত সওয়া ২টো নাগাদ দমকলের দু’টি গাড়ি ঘটনাস্থলে পৌঁছয়। তার পরে আগুনের তীব্রতা বুঝে আসতে থাকে একের পর এক ইঞ্জিন। বাসিন্দাদের অভিযোগ, খবর পাওয়ার পরে দমকল পৌঁছতে অনেক দেরি করেছে। যদিও দমকলের বক্তব্য, খবর পাওয়ার পরে যত শীঘ্র সম্ভব পৌঁছনো হয়েছে। লেনিন সরণি দিয়ে দমকলের গাড়ি প্রথমে ঢুকলেও পরে মর্ট লেন দিয়েও গাড়ি ঢোকানো হয়। লেনিন সরণির ওই দোতলা বাড়িটির দরজা তালাবন্ধ থাকায় প্রথমে দমকলের কর্মীরা মর্ট লেনের একটি বসতবাড়ির উপর থেকে আগুন নেভানোর কাজ শুরু করেন। পরে বাড়ির জানালা ভেঙে আগুন নেভানোর কাজে হাত দেন তাঁরা।
তবে আগুন লাগার পিছনে অন্য রকম গন্ধ পাচ্ছেন পাঁচতলা ফ্ল্যাটবাড়ির ভাড়াটেরা। চারতলার ভাড়াটে মোর্তাজা রঙ্গনওয়ালার ফ্ল্যাটের একটি ঘর আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাঁর অভিযোগ, ‘‘২০০৮ সালে পাঁচতলা বাড়ি ও জ্যোতি সিনেমার বাড়ি কিনে নেন এক ব্যক্তি। তিনি বাড়ি ছাড়ার জন্য ভাড়াটেদের উপর বহু দিন ধরেই চাপ সৃষ্টি করছিলেন।’’ মোর্তাজার কথায়, ‘‘আমরা রাত ১টা নাগাদ ঘুমোতে গিয়েছিলাম। তার পরে যে ভাবে আগুন লাগল এবং খুব তাড়াতাড়ি ছড়িয়ে পড়ল, তাতে সন্দেহ তো রয়েছেই।’’ বাড়ির মালিক কে, ভাড়াটেদের উচ্ছেদ করার জন্য তাঁর কোনও অভিসন্ধি ছিল কি না, পুলিশ সে সব খতিয়ে দেখছে।