Salt lake Fire

‘আগুনে কোনও রকমে বেঁচে গেলাম, কিন্তু এখন খাব কী'

চোখের সামনে দাউদাউ করে পুরো বস্তি জ্বলছে। আর বিকট শব্দে কিছু ক্ষণ পর পর সিলিন্ডার ফাটছে। একের পর এক দমকলের ইঞ্জিন ঢুকছে। বস্তিতে ঢোকার কোনও সুযোগই নেই।

Advertisement

সুমন সিংহ (বস্তির বাসিন্দা)

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৪ এপ্রিল ২০২৩ ০৭:১৯
Share:

লেলিহান: বাঁ দিকে, জ্বলছে বস্তির ঘর। রবিবার রাতে, সল্টলেকের ফাল্গুনী আবাসনের পিছনে। ডান দিকে, বস্তি থেকে বার করে আনা হয়েছে পুড়ে যাওয়া সিলিন্ডার। ইনসেটে, সুমন সিংহ। ছবি: স্বাতী চক্রবর্তী এবং নিজস্ব চিত্র। ফাইল চিত্র।

রাজারহাটের দিকে রাজমিস্ত্রির কাজে গিয়েছিলাম। সেই কাজ শেষ করে বাড়ি ফিরছিলাম। ঠিক সেই সময়ে বাড়ি থেকে স্ত্রীর ফোন এল। প্রথমে ভেবেছিলাম, যেমন প্রতিদিন করে, তেমনই নিশ্চয়ই। ভাবতেও পারিনি, কত বড় বিপদ ঘটে গিয়েছে। ফোন ধরতেই আতঙ্কিত গলায় বলে উঠেছিল, ‘‘বস্তিতে আগুন লেগেছে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, ঘরে এসো। চার দিকে সিলিন্ডার ফাটছে। গোটা বস্তি জ্বলছে। আমরা শুধু কোনও রকমে বেরিয়ে আসতে পেরেছি।’’

Advertisement

সব কিছু শুনেই আমার সারা শরীর ঠান্ডা হয়ে গিয়েছিল। সল্টলেকের ফাল্গুনী এলাকায় বাজারের পিছনেই আমাদের এই বস্তি। ঘিঞ্জি এলাকাটা। ফলে অনুমান করছিলাম, এক বার আগুন লাগলে কী ভাবে তা দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে পারে। আর কিছু না ভেবে দ্রুত একটা গাড়ি ধরে এলাকায় ফিরি। কিন্তু, ঢুকে যা দেখলাম, তা কল্পনার থেকেও ভয়াবহ। চোখের সামনে দাউদাউ করে পুরো বস্তি জ্বলছে। আর বিকট শব্দে কিছু ক্ষণ পর পর সিলিন্ডার ফাটছে। একের পর এক দমকলের ইঞ্জিন ঢুকছে। বস্তিতে ঢোকার কোনও সুযোগই নেই।

বস্তির সামনের দিকেই আমাদের ঘর। ছোট্ট একটাই ঘর। মাত্র চার মাস আগে আমার বিয়ে হয়েছে। ঘরে নতুন জিনিসপত্র ভর্তি। দশ দিন আগে নতুন ফ্রিজ কিনেছি। বাড়ির আলমারিতে দামি জিনিসপত্র, টাকা— সব কিছু। বড় টিভিও রয়েছে। কিন্তু, কিছুই বার করে আনার সুযোগ পাওয়া যায়নি। জিনিসে ঠাসা সেই ঘরটাই জ্বলে যেতে দেখলাম। স্ত্রী, মা, ভাগ্নে-ভাগ্নি এবং জামাইবাবুকে নিয়ে থাকি সেখানেই। একটু হুঁশ ফিরতেই ভিড়ের মধ্যে ওদের খুঁজতে শুরু করলাম। শেষে অবশ্য সবাইকে খুঁজে পেয়েছি।

Advertisement

আমার ঘরে দুটো সিলিন্ডার রয়েছে। সেই সিলিন্ডারগুলো দমকলের কর্মীরাই টেনে বাইরে বার করে এনেছেন। এই বস্তিতে অনেকের ঘরেই একাধিক সিলিন্ডার আছে। সেই কারণে বোধ হয় আগুনটা এত দ্রুত ছড়াল। বেঁচে তো গেলাম, কিন্তু এ বার খাব কী? কোথায় থাকব? কিছুই জানি না। আমার একটা ছোট্ট পান-বিড়ির দোকানও রয়েছে। দোকানের কিছু জিনিস এবং টাকা ঘরেই রাখা ছিল। সে সব কিছু পুড়ে ছাই। সদ্য অনেক টাকা খরচ করে বিয়ে করেছি। আগুন সব তছনছ করে দিল।

বেশ কিছু ক্ষণ পরে এক বার ঘরে ঢোকার চেষ্টা করেছিলাম। সামনে এসেও নিজের ঘরটা চিনতে পারছিলাম না। সামনে গিয়ে দেখি, তিল তিল করে টাকা জমিয়ে কেনা শখের ফ্রিজটা পুড়ে খাক হয়ে গিয়েছে। দেওয়াল থেকে পড়ে ভেঙে গিয়েছে বড় রঙিন টিভিটাও। ঘরের ভিতর তখন আগুন নেই। কিন্তু প্রচণ্ড তাপে মাটিতে পা রাখতে পারছিলাম না। আর কিছু অবশিষ্ট আছে কি না দেখতে আরও একটু ঢুকছিলাম, তখনই দমকলের কর্মীরা বার করে দিলেন।

একটু বেশি রাতে শুনতে পেলাম, বাড়ির কাছে একটা কমিউনিটি হলে আমাদের থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। লোকজনের মুখে শুনছিলাম, বস্তির পিছনে কেউ গ্যাসে রান্না করছিলেন। সেই সিলিন্ডার থেকে গ্যাস লিক করেই এই আগুন লেগে থাকতে পারে। শুধু ভাবছি, কী ভাবে এক রাতের মধ্যে গৃহহীন, কপর্দকহীন হয়ে গেলাম! দু’দিন বাজার করার মতো টাকাও এখন হাতে নেই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন