Salt Lake Accident

দু’সপ্তাহেই ভুলেছে সকলে! ঋণ আকণ্ঠ, রোজ খাবার জুটছে না, সল্টলেকে দুর্ঘটনায় ঝলসে মৃত যুবকের পরিবার অগাধ জলে

কলকাতায় ডেলিভারি বয়ের কাজ করতেন সৌমেন। বাড়িতে প্রতি মাসে চার থেকে পাঁচ হাজার টাকা করে পাঠাতেন। তাতে অন্তত কাউকে না-খেয়ে থাকতে হত না। গত দু’সপ্তাহে ছবিটা বদলে গিয়েছে।

Advertisement

আনন্দবাজার ডট কম সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ২৭ অগস্ট ২০২৫ ১৮:১৭
Share:

সল্টলেকে রেলিংয়ে গাড়ির ধাক্কার পর ঝলসে মৃত্যু হয় ডেলিভারি বয় সৌমেন মণ্ডলের। গ্রাফিক: আনন্দবাজার ডট কম।

পাঁচ-পাঁচটা পেট চালাতে হবে। অথচ রোজগার শূন্য! সঙ্গে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো রয়েছে ঋণের বোঝা। এক নয়, একাধিক ঋণ! কোথা থেকে এত টাকা আসবে? কে দেবে? ভেবে কূলকিনারা পাচ্ছেন না সল্টলেকে নিহত সৌমেন মণ্ডলের দাদা সুপ্রিয় মণ্ডল। তিনিই পরিবারের বড় ছেলে। মাথার উপরে রয়েছেন বাবা, মা। তা ছাড়া স্ত্রী এবং ছোট ভাই তাঁর দিকে তাকিয়ে। গত ১৩ অগস্ট সল্টলেকের একটা দুর্ঘটনা দক্ষিণ ২৪ পরগনার বাসন্তীর মণ্ডল পরিবারে যে অভিশাপ বয়ে এনেছে, তার নাগপাশ থেকে বেরোনোর উপায় হাতড়ে বেড়াচ্ছেন সৌমেনের দাদা। অনটনের পরিবারে এক টাকাও এখন এক লাখের সমান!

Advertisement

কলকাতায় ডেলিভারি বয়ের কাজ করতেন সৌমেন। বাড়িতে প্রতি মাসে চার থেকে পাঁচ হাজার টাকা করে পাঠাতেন। তাতে খুব সাহায্য না হলেও একেবারে না-খেয়ে থাকতে হত না কাউকে। দু’সপ্তাহ আগে সৌমেনের মৃত্যুসংবাদে তাই এই পরিবারের মাথায় বাজ পড়ে। এ বার চলবে কী ভাবে? পরিযায়ী শ্রমিক বাবার হাতে এখন কাজ নেই। সুপ্রিয় নিজে দৈনিক ৫০০ টাকার বিনিময়ে ঢালাইয়ের কাজ করেন। কিন্তু তিনিও এখন ঘরে বসে। বেকার ছোট ভাইটিও। উপরন্তু বাড়ির এই মেজো ছেলের মৃত্যুর পর তাঁর ধারে কেনা বাইকটির ইএমআইয়ের বোঝা চেপেছে পরিবারের ঘাড়ে। কখনও খাবার জুটছে, কখনও জুটছে না। বুধবার সৌমেনের দাদা আনন্দবাজার ডট কমকে ফোনে বললেন, ‘‘আমার এমন পরিস্থিতি, বাড়িঘর না-দেখলে বুঝতে পারবেন না। কোনও জায়গা থেকে যদি কোনও সাহায্য পেতাম, উপকৃত হতাম। কেউ যদি আমাকে এখন এক টাকাও দেন, তা আমার কাছে এই মুহূর্তে লাখ টাকার সমান।’’

ভাইয়ের মৃত্যুর পর দু’সপ্তাহ কেটে গেলেও কোনও সাহায্য পায়নি পরিবার, দাবি সৌমেনের দাদার। সরকারি সাহায্য তো দূরের কথা, কোনও রাজনৈতিক নেতাও সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসেননি। বিমার টাকাও আদায় করা যায়নি। যে সংস্থায় সৌমেন কাজ করতেন, তাদের তরফে পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছিল। কিন্তু হিন্দি ভাষায় সড়গড় না হওয়ায় সংস্থাকে নিজেদের বক্তব্য ভাল করে বুঝিয়েই উঠতে পারেননি তাঁরা। সুপ্রিয়ের কথায়, ‘‘ওরা তো হিন্দি বলে। ভাল বুঝিনি। কিছু কাগজ আমাকে পাঠিয়েছে। তা জমা দিতেও বলা হয়েছে। কিন্তু সরাসরি যোগাযোগ করা গেলে ভাল হত। কোথায় গেলে একটু সাহায্য পাব, জানি না। যার কাছেই যাচ্ছি, উকিল ধরতে বলছে। তা নিয়ে কথা চলছে।’’

Advertisement

মণ্ডল পরিবারের একমাত্র সম্বল বলতে এখন মাথার উপরের ছাদটুকু। নিজেদের আড়াই বিঘা জমি ছিল। তা এখন বন্ধক দেওয়া হয়েছে। সুপ্রিয় জানিয়েছেন, তাঁর ভাই সৌমেন সপ্তম শ্রেণিতে পড়াকালীন কলকাতায় কাজের সন্ধানে চলে এসেছিলেন। কেবল পরীক্ষার সময় বাড়ি ফিরতেন। আবার চলে যেতেন। টুকটাক রোজগার করতেন তখন থেকেই। শেষ যে সংস্থায় কাজ করতেন, সেখানে যোগ দিয়েছিলেন বছরখানেক আগে। যে গাড়ির জন্য এই দুর্ঘটনা, সেখান থেকে সাহায্য মেলার কথা তো? বাইকের বিমার টাকাও তো পাওয়ার কথা? সুপ্রিয়ের গলায় হতাশা, ‘‘কী জানি। সে-ই উকিলের সঙ্গেই কথা বলতে হবে। সকলে তা-ই বলছেন।’’

স্থানীয় এক পরিচিত সাহায্যের জন্য এগিয়ে এসেছিলেন বটে। বিডিও অফিসের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু যে দিন যাওয়ার কথা, সে দিন সৌমেনের বাবা অসুস্থ হয়ে পড়েন। তার পর আর যোগাযোগ করা যায়নি। কেউ আর ফোন ধরেননি। স্থানীয় এক নেতা বলেছিলেন, তাঁর দফতরে যোগাযোগ করতে। কিন্তু কোথায় কী! এখনও যে ভাইয়ের মৃত্যুর শংসাপত্রটাই হাতে পাননি সুপ্রিয়। নেতার দফতরে কী নথি দেখাবেন? অনটনের পরিবারে ঋণও প্রতি দিন বাড়ছে। ছোট ভাই কিছু দিন আগে মোবাইল কিনেছিলেন। তার ইএমআইয়ের জোগাড় করতেও হিমশিম খাচ্ছে পরিবার।

১৩ অগস্ট সল্টলেকের ৮ নম্বর ব্রিজের কাছে সিগন্যালে দাঁড়িয়েছিল সৌমেনের বাইক। আচমকা ডান দিক থেকে ছুটে আসে একটি চারচাকার গাড়ি। ধাক্কা খেয়ে বাইক-সহ পাশের রেলিংয়ের কাছে ছিটকে যান ওই যুবক। তার পর গাড়ির ভিতরের লোকজন বেরোনোর সুযোগ পেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি পাননি। গাড়িতে বিস্ফোরণ হয়। সেই আগুনে ঝলসে মৃত্যু হয় সৌমেনের। ঘাতক গাড়ির চালককে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। ভাইয়ের এ হেন মর্মান্তিক মৃত্যুর যন্ত্রণাকে গৌণ করে দিয়েছে দারিদ্র। বাবা, মা, ভাই, স্ত্রীর মুখে কী ভাবে খাবার তুলে দেবেন, তা ভাবতে গিয়ে রাতের ঘুম উড়েছে সুপ্রিয়ের।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement
Advertisement