যেখানে চলেছে গুলি। রবিবার। — নিজস্ব চিত্র।
জগৎপুরে তৃণমূলকর্মী খুনের রেশ এখনও কাটেনি। তার মধ্যেই ফের গুলি। এ বারও সেই রাজারহাটেই। ঘটনাস্থল নারায়ণপুর।
শনিবারই ক্রেতা-সুরক্ষা মন্ত্রী সাধন পাণ্ডের দাবি ছিল, মুম্বই, উত্তরপ্রদেশ থেকে আমেরিকা সর্বত্র গুলি চলে। চলতেই পারে। দেশ শান্তিতেই আছে। রবিবার ভরদুপুরে রাজারহাটের নারায়ণপুরের পূর্ব বেড়াবেড়ির চটকল মোড়ে সেই ‘শান্তির’ আরও এক নমুনা দেখলেন বাসিন্দারা। এক দুষ্কৃতীর ছোড়া গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে এক গাড়ি মেকানিকের পায়ে লাগে। তাঁর নাম রাজু আলম। আরজিকর হাসপাতালে আহত রাজুর চিকিৎসা হয়।
এ দিনই জগৎপুরে তৃণমূলকর্মী হত্যাকে ঘিরে বাগুইআটির স্কুলপাড়ার একটি ক্লাবের মাঠে স্থানীয়দের কনভেনশন ছিল। সেখানে বাসিন্দারা ক্ষোভ উগরে দেন। অনুষ্ঠানে স্থানীয় বাম ও কংগ্রেসের নেতৃত্বের একাংশকেও দেখা যায়। বৃহস্পতিবার বাগুইআটির জগৎপুরে তৃণমূল কর্মীর হত্যার পর থেকে উত্তপ্ত হয়েছে গোটা এলাকা। সেই ঘটনার এখনও কোনও কিনারা হয়নি। খুনের ঘটনায় গ্যাসবাবুকে গ্রেফতার করে জেরার পরে রবিবার ভোরে আরও এক অভিযুক্তকে গ্রেফতার করেছে বিধাননগর পুলিশ। সেই ব্যক্তির নাম গোপাল বিশ্বাস ওরফে ইঁদুর গোপাল। স্থানীয় সূত্রের দাবি, ইঁদুর শাসক দলের যুবনেতা বিশ্বজিৎ ওরফে বাবাই বিশ্বাসের ঘনিষ্ঠ বলে এলাকার খবর। এ দিকে, এই খুনের পিছনে তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের কোনও যোগ নেই বলে এ দিন তৃণমূল ভবনে দাবি করেন সাংসদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। নিহত সঞ্জয়কে তৃণমূলকর্মী বলে স্বীকার করলেও, অভিযুক্তদের সঙ্গে দলের কোনও যোগ নেই বলে জানিয়েছেন অভিষেক। তিনি বলেন, ‘‘কোনও মৃত্যু নিয়েই রাজনীতি করা ঠিক নয়। যারা খুন করেছে, কাউকেই রেয়াত করা হবে না। আইন আইনের পথে চলবে।’’
যদিও অভিষেকের সার্টিফিকেট দেওয়া ‘তৃণমূলকর্মী’ নিহত সঞ্জয় সম্পর্কে এলাকার মানুষের অভিযোগ আছে নানা রকম। যেমন এলাকায় ঢুকলেই শোনা যায়, তাকে তোলা না দিয়ে সেখানে প্রোমোটিং বা জমির দালালি ছিল কার্যত অসম্ভব। কেউ সঞ্জয়ের বিরোধিতা করলে তাকে হাতে ও ভাতে, দু’ভাবেই মারা হতো। এবং এই খুনের পিছনে এই ধরনের কাজ সংক্রান্ত কোনও ব্যক্তিগত আক্রোশই কাজ করেছে বলে ধারণা পুলিশের।
এ সব কাণ্ডের মধ্যে ফের গুলির ঘটনায় আরও বেড়েছে রাজারহাট এলাকার বাসিন্দাদের আতঙ্ক এবং বিরক্তি। আইন-শৃঙ্খলার অবনতির দাবি তুলে পুলিশের বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগরে দিয়েছেন সাধারণ মানুষ। তাঁদের অভিযোগ, তিন দিনে পরপর দু’বার গুলি চলার ঘটনা ঘটল। এত অস্ত্র ঢুকে পড়ছে অথচ পুলিশ নিশ্চুপ। তারা কোথায় থাকে? পুলিশের অবশ্য দাবি, বাগুইআটির ঘটনার সঙ্গে এ দিনের গুলি চালনার ঘটনার কোনও সম্পর্ক নেই।
পুলিশ জানিয়েছে, মহম্মদ শাহিদ নামে নারায়ণপুরের এক সমাজবিরোধী গত ৬-৭ মাস ধরে এলাকা ছাড়া ছিল। বিধাননগরের পুলিশ কমিশনার জাভেদ শামিম বলেন, ‘‘এই শাহিদ এলাকার পরিচিত দুষ্কৃতী। কয়েক মাস আগে বিপুল পরিমাণ জাল নোট-সহ তাকে গ্রেফতার করেছিল পুলিশ। কিন্তু কিছু দিন পরে সে আদালত থেকে জামিন পায়। আপাতত সে বিধাননগর কমিশনারেট এলাকায় থাকে না। শাসনের দিকে ঘোরাফেরা করে। আজও সে এলাকায় ঢুকে এই ঘটনা ঘটায়। যাকে গুলি করতে গিয়েছিল শাহিদ, সেই আজহারও এলাকার অপর এক দুষ্কৃতী।’’ পুলিশ জানায়, মোটরবাইকে চড়ে শাহিদ এ দিন চটকল মোড়ের কাছে আসে। সে সময়ে সেখানেই মোটরবাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল আজহার। স্থানীয়দের দাবি, আজহারকে দেখতে পেয়েই শাহিদ গুলি চালায়। সে সময়ে সবে দোকান খুলছিল গাড়ি মেকানিক রাজু। গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে রাজুর পায়ে লাগে। ঘটনাস্থল থেকে শাহিদ এবং আজহার দু’জনেই চম্পট দেয়।
পুলিশের দাবি খারিজ করে অবশ্য স্থানীয় মহলের দাবি, অভিযুক্ত শাহিদ এবং আজাহার দু’জনেই তৃণমূল আশ্রিত। সিন্ডিকেটের বখরা, এলাকার দখলদারি নিয়েই দু’জনের গোলমালের ফল এ দিনের ঘটনা।
২০১২-এ রাজারহাটে গুলি চালনার ঘটনার প্রতিবাদে প্রতি বছর মিছিল করেন সব্যসাচীবাবু। এ দিন বিকেলে রাজারহাটে ওই মিছিলে ছিলেন তিনি। স্থানীয়দের তোলা অভিযোগ অস্বীকার করে তিনি বলেন, ‘‘দু’জনেই সমাজবিরোধী। তৃণমূলের সঙ্গে এদের কোনও সম্পর্ক নেই।’’ সব্যসাচীবাবু এমন দাবি করলেও স্থানীয় তৃণমূল সূত্রের খবর, দুই সমাজবিরোধীদের সঙ্গে তৃণমূলে সদ্য যোগ দেওয়া একটি অংশের সম্পর্ক রয়েছে।
অন্য দিকে পুলিশের একটি সূত্রের দাবি, জগৎপুরে সঞ্জয়ের হত্যার ঘটনায় দুষ্কৃতীদের অর্থ সরবরাহ করেছিল ধৃত ইঁদুর। এমনটাই অভিযোগ জানানো হয়েছিল নিহত সঞ্জয়ের পরিবারের তরফে। এক পুলিশকর্তা জানান, ঘটনার পর থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছিল ইঁদুর। গোটা ঘটনা সম্পর্কে সে অবহিত বলেই প্রাথমিক তদন্তে জানা গিয়েছে। তাই তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে অভিযোগের সত্যতা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
তবে এখনও অধিকাংশ অভিযুক্তকেই ধরতে পারেনি পুলিশ। সূত্রের দাবি, প্রাথমিক তদন্তের পরে পুলিশ নিশ্চিত স্থানীয় দুষ্কৃতীদের সঙ্গে কয়েক জন বহিরাগত দুষ্কৃতী ছিল। যাদের মধ্যে ভিন্ রাজ্যের এক দুষ্কৃতীও জড়িত বলে তথ্য পেয়েছে পুলিশ। ঘটনাস্থলের অদূরে একটি সিসিটিভি থেকেও গুরুত্বপূর্ণ সূত্র মিলেছে বলে পুলিশ সূত্রে খবর। তবে খুনের ঘটনায় কয়েকটি ক্ষেত্রে ধন্দে পুলিশ। বিশেষত ঘটনার দিন সঞ্জয় ওই সময়ে কোথায় ও কী ভাবে যাবে, এই তথ্য দুষ্কৃতীরা পেল কোথা থেকে? সে প্রশ্নের জবাব খুঁজছে পুলিশ। পাশাপাশি, সঞ্জয়ের গতিবিধি সম্পর্কে এত নির্ভুল তথ্য কোথা থেকে পেল দুষ্কৃতীরা, সে বিষয়ে তদন্তকারীদের একাংশের অনুমান, সর্ষের মধ্যেই ভূত।
বাসিন্দাদের অভিযোগ, দুষ্কৃতীদের মুক্তাঞ্চল হয়ে উঠেছে বাগুইআটি থেকে রাজারহাট। আইনের শাসন উধাও। উপরন্তু দুষ্কৃতীরা থাকছে রাজনৈতিক দলের ছত্রচ্ছয়ায়। পুলিশ অবশ্য মুখে কুলুপ এঁটেছে।