ভগ্ন সেতুর নীচ থেকে বেরিয়ে আসছে একটা রক্তাক্ত হাত। সেই হাতেই জলের বোতল গুঁজে দিচ্ছেন পথচারীরা। কারও শুধু বেরিয়ে রয়েছে মাথা। সেখানে ক্ষতে পড়েছে তুলোর প্রলেপ। কিন্তু বাকি শরীরটা কংক্রিটের তলায়। সেখান থেকে তাঁকে টেনে বের করার শক্তি উপস্থিত জনতার নেই।
বৃহস্পতিবার ভরদুপুরে আচমকা এমন সব দৃশ্যের সামনে পড়ে গিয়ে শিউরে উঠলেন শহরবাসী। রবীন্দ্র সরণি ও কালীকৃষ্ণ ঠাকুর স্ট্রিটের সংযোগস্থল। লোকমুখে গণেশ টকিজের মোড় বলেই যার পরিচিতি। ব্যস্ত ঘিঞ্জি চেনা তল্লাটটা এক পলকে যেন প্রত্নতাত্ত্বিক ভগ্নস্তূপ।
মাথার উপরে সেতু ভেঙে পড়ার অভিজ্ঞতা এর আগে কলকাতার হয়নি। তিন বছর আগে উল্টোডাঙা উড়ালপুল ভেঙে পড়েছিল খালের জলে। কিন্তু ঘটনাটা ছুটির দিন কাকভোরে ঘটায় কোনও প্রাণহানি হয়নি। কিন্তু এ বার দিনদুপুরে ভিড়ে-ঠাসা শহর চরম আতঙ্কে মুখোমুখি। আমরি হাসপাতালে বিষাক্ত ধোঁয়ায় দম আটকে ৯২ জনের মৃত্যু বা স্টিফেন কোর্টের বহুতলে অগ্নিকাণ্ডে ৪৩ জনের প্রাণহানির ঘটনার সঙ্গে তাই এক নিঃশ্বাসে উচ্চারিত হচ্ছে উড়ালপুল-বিপর্যয়। ভূমিকম্পে ধ্বস্ত এলাকায় যে ভাবে টেনে বের করা হয় ছিন্নভিন্ন, থেঁতলানো শরীর— ত্রুটিপূর্ণ সেতু মাঝপথে আছড়ে পড়ে অবিকল সেই অভিজ্ঞতার শরিক করে দিল কলকাতাকে।
পুলিশের সিসিটিভি-র ছবিতে সেতু ভেঙে পড়ার যে মুহূর্তটি উঠে এসেছে, একাধিক ট্যাক্সি-এসইউভি-মাঝারি ও ছোট গাড়ি চাপা পড়তে দেখা গিয়েছে। ছিলেন কয়েক জন পথচারীও। তাঁদের মধ্যে দু’জনকে প্রাণ নিয়ে ছিটকে বেরোতে দেখা যায়। প্রত্যক্ষদর্শীদের দাবি, এর সঙ্গে লরি, একাধিক মোটরবাইক আর রিকশাও উড়ালপুলের নীচে থাকার সম্ভাবনা রয়েছে।
টিনের কৌটোর মতো দুমড়ে যাওয়া একটি টাটা সুমোর মধ্যে কাঠ হয়ে বসেছিলেন এক প্রৌঢ়। নদিয়ার হরিণঘাটার বাসিন্দা গোপাল দেবনাথ। কাঁপতে কাঁপতে বললেন, ‘‘আচ্ছা আমার বউ, মেয়ে, নাতি-নাতনিগুলোকে কি কোনও হাসপাতালে নিয়ে গেল?’’ পঞ্জাব থেকে বেড়িয়ে হাওড়া স্টেশনে নামার পরে গোপালবাবুদের গাড়িটা ভেঙে পড়া উড়ালপুলের দু’টো লোহার বিমের মাঝে আটকে গিয়েছিল। কে, কী ভাবে বেরিয়ে এসেছেন জানেন না।
গিরিশ পার্কের মহম্মদ জিবরানের দিশেহারা দশা। বেলা আড়াইটেয় কাকিমা শাবানা বানুর ফোনটা পাওয়া ইস্তক পাগলের মতো পাক খাচ্ছেন। জনে-জনে বলছেন, ‘‘কাকিমা ফোন করে বললেন, ধ্বংসস্তূপের নীচে আটকে আছি, আমায় বাঁচাও!’’ বিকেল অবধি মহিলার খোঁজ নেই। জিবরানকে কেউ কেউ বোঝালেন, ভরসা রাখো! নেপালের ভূমিকম্পেও তো চার দিন বাদে জ্যান্ত মানুষ উদ্ধার হয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দা তথা পানের দোকানদার গোলাপলাল সরকারের আত্মীয়দের অবশ্য আর কোনও দুরাশা বেঁচে নেই। খবর পেয়েছেন, ভেঙে পড়া উড়ালপুলের নীচে দোকানঘরটুকুর সঙ্গে গোলাপবাবুও চিরতরে মুছে গিয়েছেন।
ব্রেবোর্ন রোডের বাসিন্দা এক মহিলা অঝোরে কাঁদছিলেন। পাশ থেকে একজন জানালেন, তাঁর বোন ওই চত্বর দিয়ে বাসে করে যাওয়ার সময়েই নাকি তাঁর সঙ্গে ফোনে কথা হচ্ছিল। আচমকা একটা শব্দ! তার পরই ফোন বন্ধ। সন্দীপ হালদার নামে ট্রাফিক পুলিশের এক সার্জেন্ট গুরুতর জখম হয়ে হাসপাতালে।
কংক্রিটের ধুলো, ঝাঁ ঝাঁ রোদ আর থিকথিকে ভিড়ের মধ্যেই বিবেকানন্দ রোডের উপরে আধ-ভাঙা উড়ালপুলের অক্ষত অংশটি কাঁপছিল মাঝেমধ্যে। তাই দেখে জনতাকে তাড়াতে একবার লাঠির ভয় দেখাল পুলিশ। ‘হিল রহা, হিল রহা’ বলে ভিড়টা আর্ত চিৎকার করে উঠল। খানিকটা ফাঁকা ছিল রবীন্দ্র সরণি। সেটাই এ দিন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়-সহ মন্ত্রী, আমলা, ভিআইপিদের যাতায়াতের পথ হিসেবে নির্দিষ্ট হয়ে যায়। মুখ্য সচিব, পুলিশ কমিশনার রাজীব কুমার থেকে শুরু করে প্রায় সব আইপিএস-কর্তা, কলকাতা পুলিশের সব থানার অফিসাররা ওই রাস্তায় হত্যে দিয়েছেন। ফুটপাথের ধারে চেয়ার পেতে মুখ্যমন্ত্রী অস্থায়ী অফিস সাজিয়ে বসেছেন। রাতে হাসপাতালেও যান।
ভিআইপি-রা কেউ কেউ স্থানীয় লোকের তোপে পড়েছেন অবশ্য। জোড়াসাঁকো কেন্দ্রের তৃণমূল প্রার্থী স্মিতা বক্সীকে যেমন সরে যেতে বলে ক্ষুব্ধ জনতা। বিকেল থেকে মূল উদ্ধারকাজটা সেনাবাহিনীই সামলাচ্ছিল। বিপর্যয়ের খবর পেয়ে সিআরপিএফের একটি ইউনিট বা জাতীয় বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনীর সদস্যেরা নিজেরাই ঘটনাস্থলে চলে আসেন। বন্দর কর্তৃপক্ষের ঢাউস ক্রেন ছাড়াও আরও কয়েকটি ক্রেন নিয়ে এসে ধ্বংসস্তূপ সরানোর কাজ আগেই শুরু হয়। অলোক সান্যাল নামে এক ইনস্পেক্টর একাই প্রায় পাঁচ জনকে টেনে বার করেন।আশপাশের বাড়ির ছাদ থেকে উদ্ধারকারীদের জন্য জলের বোতল ছোড়া হচ্ছিল। স্বেচ্ছাসেবী ক’জন কর্মী আবার রিলে দৌড়ের আদলে সারিবদ্ধ হয়ে জলের বোতল সরবরাহ করতে থাকেন। পরে সেনাবাহিনীর সঙ্গেও প্রাণপণে সঙ্গত করেন স্থানীয় বাসিন্দারা। একটা-একটা করে লোহার টুকরো কাটতে সময় লাগছিল। উদ্ধারকারীদের গ্যাসকাটারের সংঘাতে আগুনের ফুলকি ছড়াচ্ছিল অহরহ। আশপাশের বাড়িগুলির বিদ্যুৎসংযোগ ছিন্ন করে দেওয়া হয়। পাল্লা দিয়ে চলছিল শাবল দিয়ে মাটি খোঁড়াও। এক-একটি দেহ উঠে আসার সঙ্গে-সঙ্গে অ্যাম্বুল্যান্সের তৎপরতা। কে জীবিত, কে মৃত যাচাই করার অবকাশ নেই। সরু রাস্তা ফাঁকা করতেই ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটছে অ্যাম্বুল্যান্স।
স্ট্রেচারগুলো শুধু ভেসে যাচ্ছিল রক্তে। ভগ্ন সেতু আর ছিন্ন দেহ বুকে নিয়ে অবিরাম রক্তক্ষরণে তখন বিহ্বল শহরটাও।