মায়ের চোখের ছানি অস্ত্রোপচারের সামান্য খরচও টানতে পারছিলেন না সংসারের একমাত্র রোজগেরে সুদল। গয়নাবড়ি বানিয়ে সামান্য কিছু আয় করতেন পার্বতীদেবী। এখন প্রায় অন্ধ। বিড়ির সুখটান দিতে দিতে সুদল ভাবছিলেন, মেয়ের স্কুলের এই শেষ বছরটা কোনওক্রমে টেনে দিলে কিছুটা চিন্তা কমবে। দেনার দায়ে তিন বছর বউটাকে কোনও কাপড় কিনে দিতে পারেননি। তার উপরে এখনও দশ হাজার টাকা চাষের দেনা। ভাবতে ভাবতেই ডাক এল ভোলানাথের। ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। পটচিত্র আর টেরাকোটাগুলো শুকনো জায়গায় সরিয়ে রাখতে একছুট লাগালেন সুদল। এক দিকে তখন অর্ধসমাপ্ত মণ্ডপ ঢাকা দেওয়া, অন্য দিকে ঘরের ভিতরে চলছে বাড়িঘর ফেলে আসা মানুষগুলোর জোরকদম কাজ।
অভাব সুদলদের শিল্পীমনকে ম্লান করতে পারেনি। আর তাই ওঁদের নিরলস পরিশ্রমকে পুঁজি করে ফি বছর পুজোকমিটিগুলির লড়াই সেরার সেরা হওয়ার। পুজো মানে মানুষের আনন্দ নতুন কাপড়-জামায়, নিত্যনতুন স্বাদ আর রাত জেগে ঠাকুর দেখায়। কিছু অর্থপ্রাপ্তি আর স্বীকৃতির আশায় সুদলদের আনন্দ কিন্তু অনেক গভীর আর স্থায়ী। বাস্তবের লাগামছাড়া দৌড়ে মানুষের মধ্যে মাটির টান জাগিয়ে তুলতে পুজোয় লোকশিল্প তুলে আনার রেওয়াজ কিছু কাল ধরেই দেখা যাচ্ছে, জানালেন উত্তরের এক প্রখ্যাত ক্লাবের পুজোকর্তা। শহরের উত্তর থেকে দক্ষিণ চক্কর দিলে সেরকমই কিছু চোখে পড়ে।
যেমন, উত্তর কলকাতার ‘হরি ঘোষ স্ট্রিট সর্বজনীন’। ৭৫তম বর্ষে তাদের নিবেদন আটচালার মণ্ডপ। টালির চাল, ডোকরার অনুকরণীয় শিল্পে গ্রামবাংলার ঝলক থাকবে সেখানে। একচালার সাবেক প্রতিমা। গয়না ও সাজেও ডোকরার প্রাধান্য। পঞ্চমী থেকে নবমী দর্শনার্থীদের জন্য থাকছে ধামসা-মাদলের তালে নাচও।
চাঁদের বুড়ির চরকা দিয়ে সুতো কাটার গল্প এখনকার ছোটদের অজানা। সেই সুতো কাটার গল্প বলবে গড়িয়ার ‘কেন্দুয়া শান্তি সঙ্ঘ’। এ বার তাদের পুজো পা দিল ৪১ বছরে। মণ্ডপ যেন তাঁতির বাড়ি। সেটির চালা টোপর আকৃতির। মাটির মেঝে, নিকানো উঠোন, টিনের দেওয়াল। তাঁতের শাড়ি দিয়ে হচ্ছে অন্দরসজ্জা। প্রতিমার পরিধানে থাকবে তাঁতবস্ত্র ও সুতোর অলঙ্কার। এমনকী, এই পুজোয় এলে চাক্ষুষ করা যাবে কাঠ ও মোটর চালিত চরকায় সুতো কাটা। রঙ্গবতীতে সুতো গোটানো থেকে মাকু ও নলীতে তাঁত বোনা।
এক সময়ে ফুলিয়ার তাঁতশিল্পের সমাদর ছিল সারা বাংলায়। সময়ের স্রোতে সেই শিল্প আজ লুপ্তপ্রায়। সেই শিল্পকেই ফিরে দেখবে ঢাকুরিয়ার শহিদনগর সর্বজনীন। শান্তিপুরের ফুলিয়া থেকে শিল্পীরা এসে তাঁতের শাড়ি ও সামগ্রী দিয়ে সাজিয়ে তুলবেন মণ্ডপ। প্রতিমা হবে সনাতনী। মোহনবাঁশি রুদ্রপালের নিপুণ হাতের ছোঁয়ায়, বিভিন্ন বর্ণময় রঙে রঙিন হয়ে উঠবেন দুর্গা।
আর জি কর হাসপাতাল সংলগ্ন ‘সরকারবাগান সম্মিলিত সঙ্ঘ’-এর দুর্গাপুজো ৯৭ বছরে পা দিচ্ছে লোকশিল্পের চমকে। মণ্ডপসজ্জায় বাংলার মাটির কাজ, পটশিল্প, টেরাকোটা, বাঁশের ঝুড়ি, মেদিনীপুরের নতুন গ্রামের কাঠের কাজ, শান্তিনিকেতনের আলপনার পাশাপাশি থাকবে বিহারের মধুবনী চিত্র এবং গুজরাতের এক বিশেষ ধরনের শিল্প। প্রতিমাতেও থাকছে ডোকরার কাজ এবং মধুবনী চিত্রকলার প্রভাব।
আভিজাত্য আর শিল্পের মিশেলে সাজছে ‘গল্ফ ক্লাব রোড দুর্গাপুজো কমিটি’র মণ্ডপ থেকে প্রতিমা। রয়্যাল ক্যালকাটা গল্ফ ক্লাব সংলগ্ন এই পুজোয় মণ্ডপের বাইরে বিশেষ ধরনের সিল্কের উপরে তাইল্যান্ডের দেবদেবীর আদলে পেন্টিংয়ে মহালয়ার গল্প থাকছে। মণ্ডপের ভিতরে পটের উপর পিওর সিল্কে আঁকা হচ্ছে রামের অকালবোধন। আলোর ব্যবহারে থাকছে ব্যাকলাইট। প্রতিমা সাবেক, একচালার।
‘বেলেঘাটা সন্ধানী’র মণ্ডপ থেকে প্রতিমায় থাকছে মাটি, পটচিত্র এবং বিভিন্ন লোকশিল্পের মিশ্রণ। আধুনিক জীবনযাত্রার ইঁদুরদৌড়ে কোণঠাসা লোকশিল্পকে ফিরিয়ে আনাই ৪৫ বছরে পা দেওয়া এই পুজোর অন্যতম প্রয়াস। পুজোকর্তারা জানালেন, মণ্ডপ সাজবে মুখোশ এবং কুলো দিয়ে। ভিতরে পেন্টিংয়ের মাধ্যমে দেখানো হবে রামায়ণ-মহাভারতের কাহিনি। প্রতিমার চালচিত্রেও থাকছে লোকশিল্পের ছোঁয়া। মেদিনীপুরের পিংলার শিল্পীদের নিরলস প্রচেষ্টায় এক অন্য সাজে সেজে উঠবে ‘সন্ধানী’।
‘বটতলার বই’-এর যুগে কাঠের উপর ছবি খোদাই করে তাতে রং লাগিয়ে ছাপ তোলা হত বইয়ে।সেই স্মৃতিকে হাতড়ে হারিয়ে যাওয়া কাঠখোদাই শিল্পের কোলাজে সাজবে ‘শোভাবাজার সর্বজনীন দুর্গোৎসব’-এর মণ্ডপ। কাঠের উপর খোদাই না করে খোদাইয়ের লাইন বা নকশা কাঠের টুকরো দিয়ে তৈরি হবে কাঠ-কোলাজ। কাঁথি থেকে আসা শিল্পীদের পরিশ্রমে হচ্ছে মণ্ডপের অন্দর ও বাইরের এই সজ্জা। প্রতিমা সাবেক মৃন্ময়ী। উদ্যোক্তাদের মতে, আলোকসজ্জায় নতুনত্ব এই পুজোর আরও এক বৈশিষ্ট্য হতে চলেছে।
কলাইয়ের বাসন দিয়ে সাজবে উত্তরের আর এক পুজো ‘কবিরাজ বাগান সর্বজনীন দুর্গোৎসব’-এর মণ্ডপ। বাসনের উপরে বিশেষ প্রক্রিয়ায় করা হয়েছে মিনার কাজ। তাই দিয়েই সাজছে মণ্ডপের ভিতর ও বাইরে। এক পুজোকর্তার কথায়, “মিনে করা কলাইয়ের বাসন এখন অচল। অন্তত কিছু মানুষ তো জানবেন লুপ্তপ্রায় এই শিল্পের কথা।” প্রতিমা একচালা সাবেক। পোশাক ও গয়নায় মিনের কাজের প্রভাব থাকবে।
হারানো শিল্পের এই ঝলক কতটা মনে রাখবেন দর্শক, তা জানেন না সুদল। কিন্তু তিনি ঠিক করেছেন, পুজোর এই প্রাপ্তি থেকেই মায়ের চোখ অপারেশন করাবেন। বউয়ের জন্য একটা শাড়ি আর মেয়ের পড়ানোর খরচ উঠে যাবে এ বারের মতো। বাকিটা বরং তোলা থাক আগামী বারের জন্য।