লোকাভাব তীব্র, বারবার দেরি ফরেন্সিক দলের

ফরেন্সিক বিভাগের দাবি, হাতে গোনা লোক নিয়ে কলকাতা, বিধাননগর এবং হাওড়া পুলিশ কমিশনারেট এলাকা সামলাতে হয় তাদের। বিশাল থানা এলাকায় পরপর ঘটনা ঘটতে শুরু করলে সব সময়ে দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছনো যায় না।

Advertisement

নীলোৎপল বিশ্বাস

শেষ আপডেট: ২৫ জানুয়ারি ২০১৯ ০২:৪৫
Share:

হতাশ: পোড়া ঘরে ঢুকতে না পেরে কান্নায় ভেঙে পড়েছেন মৃত চন্দনা দাসের মা। বৃহস্পতিবার, বেহালায়। ছবি: দেবস্মিতা ভট্টাচার্য

লোক নেই, অথচ কাজের প্রবল চাপ! তাই অগ্নিকাণ্ডের পরে বুধবার গোটা দিন ঘটনাস্থল দেখতে যেতেই পারলেন না ফরেন্সিক বিভাগের কর্মীরা।

Advertisement

যার জেরে দিনভর বেহালার সুভাষপল্লির পোড়া ঘর তালাবন্ধ করে রাখল পুলিশ। শীতের রাতে ঘরের বাইরেই থাকতে হল বাসিন্দাদের। নাজেহাল হলেন আশপাশের পুড়ে যাওয়া আরও তিনটি ঘরের বাসিন্দারাও। বৃহস্পতিবার অবশেষে বিকেল পৌনে পাঁচটা নাগাদ ঘটনাস্থলে দেখা গেল ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞদের। তার আগে সুভাষপল্লির বাসিন্দারা ক্ষোভ উগরে দিয়ে বলেন, ‘‘ঘর তো পুড়েইছে, গুরুত্বপূর্ণ সব নথিও আমাদের পোড়া ঘরের ভিতরে তালাবন্ধ হয়ে পড়ে ছিল। হাসপাতালে, থানায় নথি দেখতে চেয়েছে। এত দেরিতে ফরেন্সিক এল কেন?’’

ফরেন্সিক বিভাগের দাবি, হাতে গোনা লোক নিয়ে কলকাতা, বিধাননগর এবং হাওড়া পুলিশ কমিশনারেট এলাকা সামলাতে হয় তাদের। বিশাল থানা এলাকায় পরপর ঘটনা ঘটতে শুরু করলে সব সময়ে দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছনো যায় না। কোথায় আগে যাওয়া হবে, তা ঠিক করা হয় ঘটনার গুরুত্বের বিচারে। যদিও প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে, সরকারি বিভাগের লোকাভাবের জন্য সাধারণ মানুষকে ভুগতে হবে কেন? উত্তরে ফরেন্সিক দফতরের অধিকর্তা ওয়াসিম রাজা বলেন, ‘‘আমাদের লোক কম রয়েছে। বেহালায় এক জনের মৃত্যু হয়েছে। বিষয়টি অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ! বিকেলেই আমরা নমুনা সংগ্রহ করে এনেছি।’’ বাসিন্দাদের হয়রানি নিয়ে অবশ্য তিনি কিছু বলতে চাননি।

Advertisement

বুধবার বেলা সাড়ে ১১টায় সুভাষপল্লির একটি ঘরে অগ্নিদগ্ধ হয়ে মৃত্যু হয় চন্দনা দাস (৩৫) নামে এক মহিলার। ওই ঘর থেকে আগুন ছড়িয়ে পড়ে আশপাশের আরও তিনটি ঘরে। যদিও ঘিঞ্জি এলাকা হওয়ায় দমকলের গাড়ি গিয়েও পোড়া ঘরের কাছে পৌঁছতে পারেনি। পুলিশ জানায়, স্থানীয়েরা পাশের পুকুর থেকে জল এনে আগুন নেভান। প্রাথমিক ভাবে পুলিশ জেনেছে, চন্দনা মানসিক ভারসাম্যহীন ছিলেন। পুলিশের অনুমান, চন্দনা আত্মঘাতী হয়েছেন। তবে আগুনের উৎস কী, তা জানতে ফরেন্সিক বিভাগের সাহায্য চায় পুলিশ। ঘটনার এক দিন পরে সেখানে পৌঁছয় ফরেন্সিক দল। মৃতের ভাই বিশ্বজিৎ দাস বলেন, ‘‘পুলিশ আমাদের ঘরে তালা দিয়ে রেখেছিল। বুধবার রাতে কোনও মতে বাইরে থেকেছি। ফরেন্সিক এ দিনও না এলে খুব সমস্যায় পড়তাম।’’

সম্প্রতি একই রকম অভিযোগ উঠেছিল নাগেরবাজারে বোমা বিস্ফোরণের ঘটনায়। ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞেরা যাওয়ার আগেই এলাকা ধুয়ে-মুছে সাফ করে দেওয়ার অভিযোগ ওঠে পুরসভার বিরুদ্ধে। বেহালার ঘটনা দেখে অনেকের প্রশ্ন, নাগেরবাজারের ঘটনায় মুখ পোড়ার পরেও কি হুঁশ ফেরেনি তদন্তকারীদের?

কিছু দিন আগে সোনারপুরে এক বাজি কারখানায় বিস্ফোরণের পরেও ফরেন্সিকের বিরুদ্ধে দেরিতে ঘটনাস্থলে পৌঁছনোর অভিযোগ ওঠে। রবিবার বিস্ফোরণ ঘটে। ফরেন্সিক সেখানে যায় মঙ্গলবার।

ফরেন্সিক বিভাগের যুক্তি ছিল, মাঝে ছুটির দিন থাকায় সরকারি প্রক্রিয়ায় দেরি হয়। তাই ঘটনাস্থলে পৌঁছতে দেরি হয়েছে।

বারবার ফরেন্সিকের বিরুদ্ধে দেরিতে ঘটনাস্থলে যাওয়ার অভিযোগ উঠছে কেন? ফরেন্সিক বিভাগ সূত্রের খবর, তিনটি পুলিশ কমিশনারেটের জন্য কাজ করছেন মাত্র ছ’জন ফরেন্সিক বিজ্ঞানী। ফলে পুলিশ সাহায্য চেয়ে চিঠি পাঠালে তাঁদেরই ছুটে বেড়াতে হচ্ছে শহর ও শহরতলি জুড়ে। এক আধিকারিক আবার বলেন, ‘‘লোক কম হওয়ায় অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে ঠিক করতে হচ্ছে, কোথায় আগে যাওয়া হবে। কিন্তু এমনটা হওয়ার কথা নয়। কিছু ঘটলে পুলিশ চিঠি দিয়ে ফরেন্সিকের পরামর্শ চায়। কোন ঘটনা বেশি গুরুত্বপূর্ণ আর কোনটা কম, তা আমাদের দেখার কথা নয়। ঘটনার গভীরতা মাপা নয়, তদন্ত করে রিপোর্ট দেওয়াই আমাদের কাজ।’’ সেই সঙ্গে ওই আধিকারিকের দাবি, পুলিশ তদন্তের ক্ষেত্রে আগের থেকে অনেক বেশি করে ফরেন্সিক সাহায্য চাইছে। তবে কাজ বাড়লেও সে ভাবে লোক নিয়োগ হচ্ছে না।

ফরেন্সিক বিভাগ সূত্রের খবর, ভৌত বিজ্ঞান, রসায়ন এবং জীববিজ্ঞান নিয়ে যাঁরা গবেষণা করছেন, তাঁরা ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞ হিসেবে যোগ দিতে পারেন। তবে সাধারণ গবেষণার সঙ্গে ফরেন্সিক বিভাগের কাজের অনেক তফাত। এক আধিকারিক বলেন, ‘‘একটি জ্বলন্ত গ্যাস স্টোভের কিছুটা দূরে ধরা কাগজ জ্বললে সাধারণ নিয়মে মনে হবে ওই কাগজে আগুন লেগেছে। কিন্তু আমরা খুঁজব, আগুনের উৎস কোনটা। আগুনের ‘অরিজিন’ আর ‘ভিকটিম’ গুলিয়ে ফেললে চলবে না। এ ক্ষেত্রে গ্যাস স্টোভের চারপাশের তাপমাত্র হয়তো এতটাই বেড়ে গিয়েছিল যে, কাগজটি জ্বলে উঠেছে।’’ ওই আধিকারিক জানান, সম্প্রতি ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞ নিয়োগের একটি পরীক্ষা হয়েছে। যদিও কোনও পড়ুয়াই সেই পরীক্ষায় পাশ করে কাজে যোগ দিতে পারেননি বলে তাঁর দাবি। ফরেন্সিক অধিকর্তা বলছেন, ‘‘আমাদের কাজ অনেকটাই আলাদা ধরনের। বিজ্ঞানের পড়ুয়াদের এখন অনেক আগে থেকে প্রশিক্ষণ দিয়ে তৈরি করে নেওয়ার কাজ শুরু করেছি আমরা।’’

এতে কি আদৌ সমস্যা মিটছে?

স্পষ্ট জবাব নেই ফরেন্সিক অধিকর্তার কাছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন