Coronavirus

করোনা-যুদ্ধে পানিহাটির ষাটোর্ধ্ব ‘যুবক’

সবাই যদি দূরে সরে থাকেন, তা হলে আক্রান্তদের পাশে থাকবে কে?

Advertisement

শান্তনু ঘোষ

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৬ অগস্ট ২০২০ ০২:১০
Share:

ব্যস্ত: এক করোনা আক্রান্তের বাড়িতে সুদীপবাবু। নিজস্ব চিত্র

তিনি বিরোধী দলের জনপ্রতিনিধি। তবে পুর বোর্ড ভেঙে যাওয়ায় এখন প্রাক্তন। কিন্তু তা নিয়ে ভাবিত নন পানিহাটি পুরসভার পাঁচ নম্বর ওয়ার্ডের এক সময়ের কাউন্সিলর, সিপিএমের সুদীপ রায়। করোনা-যুদ্ধে নামা ষাটোর্ধ্ব ওই ব্যক্তির দাবি, ‘‘বনগাঁর মতো ঘটনা যেন আর না ঘটে। সবাই যদি দূরে সরে থাকেন, তা হলে আক্রান্তদের পাশে থাকবে কে?’’

Advertisement

সেই ‘সঙ্কল্প’ থেকে করোনা রোগীদের শুধু হাসপাতালে ভর্তি করাই নয়, ওই রোগে বাড়িতে কারও মৃত্যু হলে সেই দেহও সৎকার করতে নিয়ে যাচ্ছেন সুদীপবাবুরা। ওয়ার্ডের অস্থায়ী সাফাইকর্মী অভিজিৎ ভট্টাচার্য ওরফে লালু, শ্মশানের বৈদ্যুতিক চুল্লির অপারেটর ভোলা-সহ এলাকারই আরও দু’জনকে নিয়ে তৈরি করেছেন দল। গত দু’মাস ধরে দিনে-রাতে ডাক এলেই লেনিনগড়, নীলগঞ্জ, মোহ‌নপুর-সহ সোদপুর ও পানিহাটির বিভিন্ন এলাকায় ছুটে যাচ্ছেন তাঁরা। কিন্তু এমন সিদ্ধান্ত কেন? সুগার ও উচ্চ রক্তচাপের রোগী সুদীপবাবুর কথায়, ‘‘অধিকাংশ জায়গায় কেউ করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন শুনলেই প্রতিবেশীরা এগিয়ে আসছেন না। পরিজনেরাও ভয় পাচ্ছেন। কিন্তু কাউকে তো এগিয়ে আসতে হবে।’’

মাস দুয়েক আগের এক রাতে শ্বাসকষ্টে ভোগা এক কোভিড পজ়িটিভ বৃদ্ধ হাসপাতালে যাওয়ার পথে অ্যাম্বুল্যান্সেই মারা গিয়েছিলেন। অন্য কেউ এগিয়ে না আসায় পুর আধিকারিকদের অনুরোধে সৎকারের দায়িত্ব নিয়েছিলেন সুদীপবাবুই। ওই ঘটনার পরেই পুর কর্তৃপক্ষকে তিনি জানিয়ে দেন, নিজের দল নিয়ে করোনা রোগীদের ভর্তি থেকে শুরু করে দেহ সৎকার— সব কাজেই তিনি আগ্রহী। সুদীপবাবু বলেন, ‘‘পিপিই-সহ যা যা সরঞ্জাম ও গাড়ির প্রয়োজন হচ্ছে, সবই পুর কর্তৃপক্ষ দিচ্ছেন। মহকুমাশাসক থেকে শুরু করে পুলিশ-প্রশাসনের সকলেই আমাদের কথা জানেন। প্রয়োজনে ডেকে পাঠাচ্ছেন।’’ গত ২৮ জুলাই কোভিডের উপসর্গযুক্ত এক বৃদ্ধাকে ভর্তির করার জন্য তাঁকেই ফোন করেছিল পুলিশ।

Advertisement

সুদীপবাবু জানান, রাতেই সঙ্গীদের নিয়ে সেখানে পৌঁছে তিনি জানতে পারেন, বৃদ্ধা, তাঁর ছেলে ও পরিচারিকা— সকলেরই কোভিড রিপোর্ট পজ়িটিভ এসেছে। এর পরে বৃদ্ধার ঘরে ঢুকে দেখা যায়, আগেই তাঁর মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু জানতেন না ছেলে বা পরিচারিকা। ওই রাতেই কামারহাটির সাগর দত্ত হাসপাতালের এক আধিকারিকের সঙ্গে যোগাযোগ করে বৃদ্ধার ছেলে ও পরিচারিকাকে নিয়ে গিয়ে সেখানে ভর্তি করান সুদীপবাবু। তার পরে গভীর রাতে ফের ওই বাড়িতে ফিরে গিয়ে নিয়ম মেনে বৃদ্ধার দেহ প্রশাসনের নির্দিষ্ট করা শ্মশানে নিয়ে গিয়ে সৎকার করেন তাঁরাই।

আবার গত ১ অগস্ট এক স্বাস্থ্যকর্মী ফোন করে জানান, আক্রান্ত এক মহিলার প্রচণ্ড শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু অ্যাম্বুল্যান্স কলকাতায় যাওয়ার ফলে আসতে দেরি হবে। এ কথা শুনেই পিপিই পরে বাইক নিয়ে ওই মহিলার বাড়িতে পৌঁছে যান সুদীপবাবু। করোনায় আক্রান্ত, বছর পঁয়তাল্লিশের ওই মহিলাকেও পিপিই পরিয়ে বাইকে দু’জনের মাঝে বসানো হয়। তার পরে তাঁরা পৌঁছে যান সাগর দত্তে। সেখানেই এখন চিকিৎসাধীন ওই মহিলা।

এখনও পর্যন্ত ১০টি মৃতদেহ সৎকার ও ১৫ জনকে হাসপাতালে ভর্তি করেছেন সুদীপবাবুরা। বিরোধী সম্পর্কে সরাসরি মন্তব্য করতে না চাইলেও পানিহাটির শাসকদলের অনেক নেতাই মানছেন সুদীপবাবুর কাজের কথা। বলছেন, ‘‘সত্যিই ভাল কাজ করছেন।’’

পানিহাটি শ্মশান তাঁর ওয়ার্ডের মধ্যেই পড়ে। গঙ্গার ঘাটে বসে সময় কাটানোর ফাঁকে ষাটোর্ধ্ব ‘যুবক’ বললেন, ‘‘ছোট থেকে কত দেহ সৎকার করেছি। লোকে তো ডোম বলেই চিনত। আবার না-হয় তা-ই হলাম।’’ কিন্তু নিজের তো শরীর খারাপ? বাধা দিয়ে সুদীপবাবু বললেন, ‘‘করোনাকে ভয় পেলে মনুষ্যত্বের জয় হবে কী করে।’’

(জরুরি ঘোষণা: কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীদের জন্য কয়েকটি বিশেষ হেল্পলাইন চালু করেছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার। এই হেল্পলাইন নম্বরগুলিতে ফোন করলে অ্যাম্বুল্যান্স বা টেলিমেডিসিন সংক্রান্ত পরিষেবা নিয়ে সহায়তা মিলবে। পাশাপাশি থাকছে একটি সার্বিক হেল্পলাইন নম্বরও।

• সার্বিক হেল্পলাইন নম্বর: ১৮০০ ৩১৩ ৪৪৪ ২২২
• টেলিমেডিসিন সংক্রান্ত হেল্পলাইন নম্বর: ০৩৩-২৩৫৭৬০০১
• কোভিড-১৯ আক্রান্তদের অ্যাম্বুল্যান্স পরিষেবা সংক্রান্ত হেল্পলাইন নম্বর: ০৩৩-৪০৯০২৯২৯)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন