অচেনা: গড়িয়াহাট মোড়ে অটো এবং যাত্রী, দুইয়েরই সংখ্যা ছিল কম। বৃহস্পতিবার। নিজস্ব চিত্র
বৃহস্পতিবার দুপুর সাড়ে ১২টা। গড়িয়াহাট মোড়। রাস্তাঘাট সুনসান না হলেও অন্য দিনের চেয়ে গাড়ির ব্যস্ততা অনেকটাই কম। গড়িয়াহাট অটো স্ট্যান্ডে পরপর অটো দাঁড়িয়ে থাকলেও যাত্রীর দেখা নেই। ফুটপাতে হাতে গোনা যে কয়েক জন দোকান খোলা রেখেছেন, তাঁদের বেশির ভাগের চোখ মোবাইলের পর্দায়।
নির্বাচন শেষ, যাত্রীও নেই। এই অবসরে অটোর পিছনে তৃণমূল প্রার্থীর সমর্থনে লাগানো ফ্লেক্স খুলছিলেন এক অটোচালক। তাঁকে দেখে খানিকটা রসিকতার সুরেই আর এক অটোচালক বললেন, ‘‘কী রে, কোথায় ভোট দিয়েছিস? পাল্টি মারলি নাকি? জানতে পারলে কাল থেকে অটো চালানো বন্ধ হয়ে যাবে কিন্তু।’’
অটো, বেসরকারি বাস বা ট্যাক্সির ইউনিয়নে চিরকালই শাসক দলের শ্রমিক সংগঠনের একচ্ছত্র দাপট থাকে। রাজ্যে সরকার যার, সংগঠন তার— বহু বছর ধরে এটাই রীতি। কলকাতা উত্তর, দক্ষিণ এবং যাদবপুর লোকসভা কেন্দ্রে শাসক দলের প্রার্থীরা দাপট ধরে রাখলেও পরিবহণ কর্মীদের ভোট কতটা তাঁদের বাক্সে গিয়েছে, তা নিয়ে একটা সংশয় রয়েছে সব পক্ষেই।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শাসকদলের অটো চালক ইউনিয়নের এক নেতার বক্তব্য, রাস্তায় জরিমানা আদায়ের নামে গত কয়েক বছর ধরে পুলিশের অত্যাচার পরিবহণ ক্ষেত্রের শ্রমিকদের খেপিয়ে তুলেছিল। যার জেরে তাঁদের বড় অংশ এ বার সরকারের বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছেন বলে দাবি তাঁর। বেসরকারি বাস, অটো এবং ট্যাক্সির চালকেরা নির্বিশেষে কম-বেশি এমন বঞ্চনার শিকার। এ নিয়ে প্রশাসনে কথা বলে লাভ না হওয়ায় ক্ষোভ ক্রমেই বেড়েছে। ওই নেতার কথায়, ‘‘মিছিলে লোক জড়ো করার সময়ে অটোচালকদের মনে পড়ে। কিন্তু পুলিশের অত্যাচার কমাতে, কাউকে পাওয়া যায় না।’’ পুলিশ তো যান নিয়ন্ত্রণের জন্যই জরিমানা করে! এক মত হতে পারলেন না ওই নেতা। তাঁর কথায়, ‘‘পুলিশ জরিমানা করে সরকারি রাজস্ব আদায় বাড়াতে।’’
কী বলছেন বিরোধী দলের ট্রেড ইউনিয়নের নেতারা? এআইটিইউসি অনুমোদিত ওয়েস্ট বেঙ্গল ট্যাক্সি অপারেটর্স কো-অর্ডিনেশন কমিটির আহ্বায়ক নওলকিশোর শ্রীবাস্তবের মতে, বিরোধী ভোটের একটা অংশ গিয়েছে বিজেপির ঝুলিতে। পরিবহণ ক্ষেত্রে ক্ষোভের জন্য পুলিশি নির্যাতনকে দুষেছেন তিনিও। তাঁর কথায়, ‘‘এ বার বিরোধী হিসেবে বিজেপিকেই বেশি ভরসা করেছেন ভোটারদের অনেকে। তবে তার পরেও ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন থাকবে। আমরা লড়াই চালিয়ে যাব।’’
গড়িয়াহাটে দু’টি রুটের আইএনটিটিইউসি-র অটোচালক ইউনিয়নের নেতা দেবরাজ ঘোষের মতে, ‘‘এ বারের নির্বাচনে বিভাজনের নীতিকে ব্যবহার করেছে বিজেপি। ধর্মীয় মেরুকরণের সেই প্রভাব পড়েছে নির্বাচনে। পরিবহণ ক্ষেত্রও তার ব্যতিক্রম নয়। এ দিন তিনি জানান, অনেক প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে লড়ে এ বার জয় এসেছে। উত্তর কলকাতা অটো ইউনিয়নের নেতা মানা চক্রবর্তী বলেন, ‘‘সব জায়গাতেই লড়াই করে আসন ধরে রাখতে হয়েছে। সে লড়াই খুবই কঠিন ছিল।’’ তবে পরিবহণকর্মীরা সরকারি নীতির কারণে তৃণমূলের বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছেন, এটা অবশ্য দেবরাজ বা মানা কেউই মনে করেন না।
ওয়েস্ট বেঙ্গল অনলাইন ক্যাব-অপারেটর্স গিল্ডের সাধারণ সম্পাদক ইন্দ্রনীল বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে, ‘‘পরিবহণ শ্রমিকেরা মূলত তাঁদের সমস্যায় সারা বছর কারা পাশে থাকেন, তা দেখেই ভোট দেন।’’ যদিও মেরুকরণের হাওয়া কলকাতা উত্তর, দক্ষিণ এবং যাদবপুরে তেমন সুবিধে করতে পারেনি বলে মত তাঁর। তবে, ভাটপাড়ায় তৃণমূল প্রার্থী মদন মিত্রের সমর্থনে অ্যাপ-ক্যাব চালকদের মিছিল আয়োজন করা ইন্দ্রনীলের মতে, সেখানে প্রবল মেরুকরণ ছাড়াও সন্ত্রাসের আবহ ছিল। সেই আবহের কারণেই প্রচারে ঝড় উঠলেও ভোটের বাক্সে তার প্রতিফলন ঘটেনি।
বাসমালিক সংগঠনের প্রতিনিধিরা অবশ্য নির্বাচনের ফল নিয়ে সরাসরি মন্তব্য করতে চাননি। সংগঠনের এক কর্তা বলেন, ‘‘সরকারে যারাই থাকুক, আমাদের সকলকে নিয়েই চলতে হবে।’’