অদম্য: বল দখলে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই। বৃহস্পতিবার। ছবি: স্বাতী চক্রবর্তী
চেহারায় তার চার গুণ, পেটানো চেহারার স্ট্রাইকারকে এগিয়ে আসতে দেখেও জমি ছাড়ল না চার ফুট আট ইঞ্চির উজ়াফা ইজাজ। তিলজলার রাজমিস্ত্রির ঘরের টিংটিঙে মেয়ের চিবুকে ধাক্কা খেয়ে জোরালো শট লক্ষ্যভ্রষ্ট হল গোলমুখে। মহাদেবী বিড়লার ছেলে-মেয়েদের নিয়ে তৈরি দলটিকে বুক চিতিয়ে রুখে দিল তপসিয়া-তিলজলার নিম্নবিত্ত পাড়ার দল ‘একতারা’।
টিকিয়াপাড়ার সামারিটান হেল্প মিশন স্কুলের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী, বড়বাজারের কাপড় কলের কর্মীর মেয়ে আকসা আলিও মাঠে নামার আগে সাবলীল ইংরেজিতে প্রত্যয়ের কথা শোনাল! ‘‘আমি জানি, কারও থেকে আমরা একফোঁটা কম নই।’’ ফুটবল টিমে এই সব মেয়েদের সতীর্থ মহম্মদ নিয়াজ়, শেখ সালিমরাও তার সঙ্গে দ্বিমত নয়। ষষ্ঠ শ্রেণির নিয়াজ় বিজ্ঞের মতো গম্ভীর মুখে বলল, ‘‘পড়া বা খেলা— দু’টোতেই মেয়েরা খুব সিরিয়াস। ঠিকঠাক অনুশীলন করলে মেয়েরাও দারুণ খেলতে পারে!’’
বৃহস্পতিবার কলকাতার শীতের দুপুরে ছেলে এবং মেয়েদের দক্ষতা, ক্ষমতা নিয়ে চিরকেলে ধারণাগুলি এ ভাবেই খানখান হচ্ছিল বারবার। গরিব-বড়লোক বা কেন্দ্র-প্রান্ত নিয়ে জনমানসে বাসা বাঁধা ‘দ্বিজাতি-তত্ত্ব’ও যেন মিথ্যে হয়ে এক ফুঁয়ে। বা বলা ভাল, সপাটে ফুটবলে লাথিতে। মিন্টো পার্কের কাছে শহরের একটি ক্লাবের টেনিস কোর্টের পাশে এ দিন শুরু হয়েছে ৪৮টি দলের ফাইভ-আ-সাইড ফুটবল-আসর। অশোক হল, মহাদেবী বিড়লার মতো স্কুলের পাশাপাশি বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার খুদে-বাহিনী। মণিপুরের মায়ানমার সীমান্তবর্তী সিংহাট গ্রাম থেকে কলকাতায় এসেছে ১৩ বছরের ছেলে কপিমিনলিয়ান এবং ১৪ বছরের কিশোরী বাহখানথেন। দুর্গম রাস্তা পেরিয়ে গ্রাম থেকে ইম্ফল হয়ে ডিমাপুর আসতেই গোটা দিন কাবার! সেখান থেকে কলকাতার ট্রেন ধরেছে। এত দূর আসার খরচ দিতে পারছিলেন না আয়োজকেরা। কিন্তু এই ছেলেমেয়েদের দল ইন্টারনেটে আবেদন জানিয়ে টাকা জোগাড় করে এসেছে। প্রথম বার গ্রামের বাইরে যাওয়া কুকি জনজাতির এই ছেলেমেয়েরা এ দিন মহানগরের তথ্যপ্রযুক্তি তালুক দেখতে গিয়েছিল।
আরও পড়ুন: তাই জু-কে হারিয়ে বড় চমক সিন্ধুর
রামপুরহাটের ঝাড়খণ্ড সীমানাঘেঁষা গড়িয়া গ্রামের সাঁওতাল ছেলেমেয়েদের উতনাও টিমের কলকাতা আসাটাও উজান-ঠেলা অভিযান। ঢাকুরিয়ার রেল কলোনির কাকলি নস্কর বা টিকিয়াপাড়ার রুকসার পরভিনদের পাড়ায় তা-ও ছেলেদের সঙ্গে ফুটবল পেটানো নিয়ে সমস্যা নেই! স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার মাঠে বীরভূমের দু’টি দলই, মাসখানেক হল গ্রামের একটি রক্ষণশীল অংশের চাপে অনুশীলন করতে পারেনি। তবু চুপিচুপি স্টেশনে জড়ো হয়ে খেলার অদম্য টানেই তারাও হাজির কলকাতায়। শিলচরের নরসিংহপুর চা-বাগান, সোনাগাছির যৌনপল্লি বা বিহার-নেপাল সীমান্তের ফরবিসগঞ্জের গরিবগুর্বোরা মিশে গেল শহুরে নামী স্কুলের পড়ুয়াদের সঙ্গে।
‘অর্জুন’ ফুটবলকন্যা শান্তি মল্লিকের কোচিংক্যাম্পের দলও রয়েছে প্রতিযোগিতায়। শান্তির দাবি, তিনি তিন মাসের অন্তঃসত্ত্বা অবস্থাতেও ফেডারেশন কাপ খেলেছিলেন। তাঁর মতে, ছেলেদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ফুটবল খেলাটা অসম্ভব নয়। আর এক অর্জুন ফুটবলার সুব্রত ভট্টাচার্য অবশ্য এই ধরনের প্রতিযোগিতাকে ‘সিরিয়াস ফুটবল’ হিসেবে দেখছেন না। তবে তিনিও বুঝছেন, মেয়েদের ঘরবন্দি রাখার মানসিকতাকে এ ভাবে ধাক্কা দেওয়া গেলে মন্দ কী! এই শহরেরই দুই কন্যা, মডার্ন হাইস্কুলের প্রাক্তনী, চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট নেহা ভাটনগর এবং আইনজীবী রিচা দাগার মাথায় খেলেছিল এই সবাইকে আপন করে নেওয়া ফুটবলের আসরের কথা। প্রধানত ইন্টারনেটের মাধ্যমে কাছের-দূরের সাধারণ মানুষের কাছে হাত পেতে হয় ফুটবলের আয়োজন। সব মিলিয়ে খরচ হচ্ছে ১৩ লক্ষ টাকা। ফাইনাল খেলা রবিবার। এই প্রতিযোগিতার অন্যতম সংগঠক মুদার পাথেরিয়ার কথায়, ‘‘বালিগঞ্জের একটি সংস্থার স্কুলেই প্রথম দেখি, মাঠের অভাবে ছেলে-মেয়েরা এক সঙ্গে খেলছে। এর দু’টি দিক আছে! মেয়েদের ভাল খেলার রোখ বাড়ছে। আর ছেলেরা মেয়েদের সমীহ করছে।’’
আরও পড়ুন: সোলের আগে মনে হয়েছিল মরেই যাব
গোটা দেশেই মেয়েদের এগিয়ে নিয়ে যেতে ফুটবল এখন আত্মবিশ্বাসের হাতিয়ার! কলকাতার রাজাবাজার থেকে ছত্তীসগঢ়ের দান্তেওয়াড়া, রাঁচির প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে জঙ্গলমহল— সর্বত্রই ফুটবলের ঢল। কিন্তু ছেলে ও মেয়েদের সচরাচর এক দলে দেখা যায় না। এ দিন সত্যিই লিঙ্গগত সীমাবদ্ধতা নিয়ে ক্লিশে ধ্যানধারণা ভাঙার অস্ত্র হয়ে উঠেছিল ফুটবল। ম্যাচে বা ম্যাচের বাইরেও পায়ে-মাথায় বল নাচানো বা শটে লক্ষ্যভেদের দৌড়ে মেয়েরা ছেলেদের সঙ্গে দিনভর পাল্লা দিয়ে গেল।
অভিনব ফুটবল আয়োজনের শরিক হয়ে নেহা-রিচারাও এখন ফুটবলে মজেছেন। মধ্য তিরিশ পার করেও সমবয়সীদের নিয়ে নিয়মিত অনুশীলন শুরু করেছেন তাঁরা।