চলন্ত ট্রেনে বোমা ফেটে যাত্রীর মৃত্যুর ঘটনাতেও শিক্ষা নিল না রেল। সপ্তাহ তিনেক আগে টিটাগড় স্টেশনের ওই ঘটনার পরেও এতটুকু পাল্টায়নি ট্রেনের যাত্রী-নিরাপত্তার ছবিটা। শনিবার রাতে ফের শিয়ালদহ দক্ষিণ শাখায় রাতের লোকালে ছিনতাই সেটাই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল।
শিয়ালদহ স্টেশনে দুষ্কৃতীরা বজবজগামী ওই ট্রেনটির মহিলা কামরায় উঠে ২-৩ জন যাত্রীকে মারধর করে তাঁদের জিনিসপত্র ছিনতাই করে পার্ক সার্কাস স্টেশনে নেমে পালিয়ে যায়। যাত্রীদের অভিযোগ, মহিলা কামরায় জিআরপি বা আরপিএফের কোনও প্রহরাই ছিল না। এই ঘটনায় দু’জনকে গ্রেফতার করেছে রেল পুলিশ।
টিটাগড়ের ঘটনার পরে পূর্ব রেলের জেনারেল ম্যানেজার আর কে গুপ্ত জানিয়েছিলেন, রাতের ট্রেনগুলিতে বিশেষত মহিলা কামরায় কড়া নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়েছে। তার পরে এখন ঘটা করে উপভোক্তাপক্ষ পালিত হচ্ছে। জেনারেল ম্যানেজার থেকে শুরু করে রেলের সব শীর্ষকর্তা অফিস ছেড়ে যাত্রীদের সুযোগসুবিধা বুঝতে রেললাইনে নেমে পড়েছেন। কর্তারা যেখানেই যাচ্ছেন, সেখানেই যাত্রীরা তাঁদের নিরাপত্তার বিষয়টি সুনিশ্চিত করার আর্জি জানাচ্ছেন। রেলকর্তারা অবশ্য এখনও পর্যন্ত আশ্বাস ছাড়া কিছুই করে উঠতে পারেননি। জেনারেল ম্যানেজারের বক্তব্যও যে কার্যত কথার কথা, শনিবার রাতের ঘটনায় তা স্পষ্ট।
রেল ও স্থানীয় সূত্রে খবর, রাত সওয়া ন’টা নাগাদ বজবজগামী ট্রেনটি শিয়ালদহ থেকে ছাড়ে। ট্রেনটি চলতে শুরু করতেই দুই যুবক লাফ দিয়ে মহিলা কামরায় উঠে পড়ে। অভিযোগ, কামরার ভিতরে ঢুকেই তারা মহিলা যাত্রীদের উপরে চড়াও হয়। এক নিগৃহীতা যাত্রী তনুশ্রী কর জানান, ওই দুই যুবক তাঁকে ভয় দেখিয়ে টাকাভর্তি ব্যাগ ও মোবাইল কেড়ে নেয়।
সহযাত্রীকে নিগৃহীত হতে দেখে পাশে বসা আর এক মহিলা যাত্রী প্রতিবাদ করেন। তখন আর এক দুষ্কৃতী প্রতিবাদী মহিলার গালে চড় মেরে কানের দুল ছিনিয়ে নেয়। তনুশ্রীদেবী প্রথমে হাতের ব্যাগটি দিতে চাননি। তখন তাঁকে বেশ কয়েকটি থাপ্পড় মারে দুষ্কৃতীরা। ইতিমধ্যে ট্রেনটি গতি কমিয়ে পার্ক সার্কাস স্টেশনে ঢুকছিল। তখনই দুই দুষ্কৃতী চলন্ত ট্রেন থেকে লাফ দিয়ে পালিয়ে যায় বলে অভিযোগ। আরও অভিযোগ, রাতের ট্রেনটিতে কোনও পাহারা ছিল না। বজবজ স্টেশনে পৌঁছে হইচই শুরু করেন নিগৃহীত দুই মহিলা। পরে শিয়ালদহ জিআরপির কাছে একটি অভিযোগ দায়ের করা হয়।
শিয়ালদহ রেল পুলিশ সুপার দেবাশিস বেজ রবিবার বলেন, ‘‘আজ দুপুরেই লিখিত অভিযোগ হয়েছে। তার পরেই তদন্ত শুরু করেছি। এই ঘটনায় অজয় মল্লিক ও ছোট্টু মণ্ডল নামে দুই যুবককে গ্রেফতার করা হয়েছে। অজয় যাদবপুর ও ছোট্টু ঘুটিয়ারি শরিফের বাসিন্দা।’’
পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, গত ছ’মাস ধরে শিয়ালদহের লোকাল ট্রেনগুলিতে ছিনতাই, পকেটমারির সংখ্যা বেড়ে গিয়েছে। জেনারেল ম্যানেজার যতই বলুন না কেন, ট্রেনে টহলদারির বিষয়টি প্রায় উঠেই গিয়েছে। পুলিশেরই একাংশের বক্তব্য, এমনিতেই জিআরপিতে যাত্রী অনুযায়ী পুলিশের সংখ্যা খুবই কম। একই অবস্থা রেলের আরপিএফ পোস্টগুলিরও। সেখানেও কর্মীর সংখ্যা হাতেগোনা বলা যায়। শিয়ালদহের গোটা ডিভিশনে এখন নয় নয় করে প্রায় ১৫ লক্ষের বেশি নিত্যযাত্রী যাতায়াত করেন। ফলে তার নিরিখে পুলিশের সংখ্যা কমে যাওয়ায় এই সব অপরাধ বাড়ছে।
একই অবস্থা দক্ষিণ-পূর্ব রেলেও। গত বৃহস্পতিবার যাত্রীদের সঙ্গে কথা বলতে হাওড়া থেকে আদ্রা পর্যন্ত গিয়েছিলেন দক্ষিণ-পূর্ব রেলের জেনারেল ম্যানেজার রাধেশ্যাম। আদ্রায় নেমে তিনি যখন যাত্রীদের সঙ্গে কথা বলছেন, তখন ওই ট্রেন থেকেই নেমে আসেন এক মহিলা যাত্রী। দক্ষিণ-পূর্ব রেলের সব কর্তার সামনেই তিনি চিৎকার করে বলতে থাকেন, ওই ট্রেনে তাঁর মোবাইল ও টাকার ব্যাগ পকেটমাররা নিয়ে নিয়েছে। সর্বসমক্ষে এই অভিযোগ শুনে জেনারেল ম্যানেজার কিছুটা বিড়ম্বনায় পড়েন। তাড়াতাড়ি জিআরপি ও আরপিএফ কর্তাদের ডেকে পাঠান তিনি। অবিলম্বে তদন্তের নির্দেশও দেন।
সাধারণ ট্রেনগুলির যখন এই অবস্থা, মেট্রো এত দিন একটু আলাদা ছিল। এখন সেখানেও মাঝেমধ্যেই অভিযোগ হচ্ছে। তবে চুরি-ছিনতাই নয়। মেট্রোয় এখন মহিলা যাত্রীদের সঙ্গে অশালীন আচরণের অভিযোগ বেশি। দক্ষিণ-পূর্ব রেলের জেনারেল ম্যানেজার এখন কলকাতা মেট্রো রেলেরও জেনারেল ম্যানেজার। শনিবার তিনি কলকাতা মেট্রো পরিদর্শন করে যাত্রীদের সঙ্গে কথা বলেন। যাত্রীদের অন্য অভিযোগের সঙ্গে এই অভিযোগও বারবার শুনতে হয়েছে তাঁকে।